বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২৫, ২০২৪

মহাসত্যের বিপরীতে দ্বিতীয় খণ্ড # ৮ম পর্ব

এই আত্মা জন্মরহিত শাশ্বত ও পুরাতন/ দেহের বিনাশ হলেও আত্মার বিনাশ হয় না! – উপনিষদ

দ্বিতীয় খণ্ড # ৮ম পর্ব

আধা আলো আধা অন্ধকারে গরব যতটা সতর্ক ছিল তুলনায় অনেক ধীরে গড়িয়ে পড়া শুরু হয়, যতটা খাড়া ভেবেছিল ঢালটা আদৌ ততটা খাড়া নয়, মাঝেমধ্যে প্রচণ্ড গতিতে পতনের সময় ভারসাম্য হারানোর মতন ব্যাপার ঘটলেও জুতোর গোড়ালি, পিঠ ও কনুই দিয়ে গতি কমাতে পারে এবং অপ্রত্যাশিতভাবেই কিছুক্ষণের মধ্যে জাজিমের মতন পুরু তৃণভূমিতে আছড়ে পড়ে।

দু'জনের শরীরের নানা জায়গায় অল্পবিস্তর আঘাত লাগলেও উভয়েই নিরাপদ অনুভব করে। রামকে বুকে নিয়েই কয়েক মিনিট হাত পা ছড়িয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকে গরব। তারপর উঠে বসে জোরে জোরে প্রশ্বাস নেয়। নিজের জামার হাতের উপর জড়ানো রামের আঙরাখার হাত দুটি খোলে, দু’ জনের গায়ে একসঙ্গে বাঁধা ফিতেটার গিট খুলে উঠে দাঁড়ায়। নিজের ফিতেটা নিজের আঙরাখায় পেঁচিয়ে বেঁধে নেয়। ওর দেখাদেখি রামও উঠে দাঁড়িয়ে নিজের আঙরাখার কোমরে পেঁচিয়ে ফিতে বাঁধে।

গরব আরেকবার বুক ভরে প্রশ্বাস নিয়ে বলে, এবার আমরা বেঁচে গেলাম, কিন্তু এখান থেকে তাড়াতাড়ি নিচে নামতে হবে, চলো রাম!

গরব পশুদের পায়ে চলা পথ ধরে হাঁটতে শুরু করে। রাম কোনও জবাব না দিয়ে চুপচাপ ওকে অনুসরণ করে। ওর ঝিমিয়ে পড়া চলন দেখে গরবের মনে হয়, এখন ওদের, বিশেষ করে রামের কিছু খাওয়া উচিত, বেচারা!

সেজন্য দ্রুত সামনের জঙ্গলটা পেরিয়ে নিকটবর্তী গ্রামে পৌছুতে চাইলেও তৃণভূমিতে কিছুদূর যাওয়ার পরই গরব থামে। রামের চলন দেখে মনে হয় সে যে কোনও মুহূর্তে পড়ে যেতে পারে, সে যেন তার প্রাণশক্তির শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে।

একটি সরু জলধারা কয়েকটি ছোটো জলপ্রপাতের স্রোত বয়ে নিয়ে একটু দূরে একটি গিরিখাতে নেমে গেছে। তার দু'পাশে ঘন চিরহরিৎ অরণ্য। ওই সরু ধারার পাশে রামকে নিয়ে বসে পড়ে গরব। শুরুতেই দু’জনে আজলা ভরে ভরে জল খায়। এই জায়গাটা সো সা লিং-এর কোনও অংশ থেকে দেখা যায় না, মঠের পেছনের সঙ্কীর্ণ গোপন মালভূমি ও নারকীয় শৈলান্তরীপ থেকেও দেখা যায় না। তাছাড়া সো সা লিং থেকে কেউ ওদের খুঁজতে বেরুলে ওরা যে পথে এসেছে, সেই পথ ধরে কখনোই আসবে না। পাহাড় ঘুরে আসতে ওদের কয়েক ঘণ্টা লেগে যাবে। তবে ওরা যে গরব ও রামকে খুঁজতে বেরুবেই এ ব্যাপারে গরবের কোনও সন্দেহ নেই, কেননা ওরা বনদের গুপ্ত রহস্য জেনে গেছে। ওরা যে কোনওভাবে এই দু ’ জনকে মেরে ফেলতে চাইবে এবং নিশ্চিতভাবেই এই উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে কোনও কসুর করবে না।

গরব যতটা পারে শুকনো খাবার খেয়ে নেয়। কিন্তু রাম খুব একটা খেতে পারে না। তার ওকি ওঠে। গরব বোঝে তিনদিনেরও বেশি সময় না খেয়ে থাকার ফলে হঠাৎ করে যথেষ্ট খেতে পারবে না সে। ওরা আবার অঞ্জলি ভরে ধারার জল খায়।

কিন্তু খাওয়ার পর রাম আরও শ্লথ হয়ে পড়ে। গরবের আগ্রহে সে উঠে দাঁড়ায় ঠিকই কিন্তু কোনও মতেই আর হাঁটার শক্তি পায় না। অনেক চেষ্টা করেও সে আর এক কদমও হাঁটতে পারে না। গরব বলে, ঠিক আছে, যতটা সম্ভব আমি তোমাকে পিঠে করে নিয়ে যাচ্ছি। হাঁপিয়ে উঠলে দাঁড়িয়ে বিশ্রাম নেব, তারপর তুমি যখন হাঁটতে পারবে, তখনই হাঁটবে। যত দ্রুত সম্ভব কোনও গ্রাম কিম্বা নিকটবর্তী খামারবাড়িতে পৌছতে হবে। একবার লোকালয়ে পৌঁছে যেতে পারলে বনরা আমাদের হদিশ পেলেও আর গায়ে হাত দেওয়ার সাহস পাবে না।

রাম বলে, না, এখানেই অপেক্ষা করি!

গরবের কোনও কথাই রাম শোনে না। গরব তখন ওকে পাঁজাকোলে তুলে নিয়ে গিরিখাতের পাশে ঘনঝোপের আড়ালে গা ঢাকা দেয়। তারপর দু’জনেই হাত পা ছড়িয়ে জোরে জোরে প্রশ্বাস নিতে থাকে।

কিছুক্ষণ বুকভরে নির্মল বাতাস নেওয়ার পর কিছুটা সুস্থ বোধ করলে রাম বলে, শোনো, তোমাকে সেদিনের কথা বলি, সেদিন সন্ধ্যায় দ্বিতীয় বেষ্টনীতে একজন বন চিকিৎসক এসে আমাকে বলে, প্রভু তোমাকে ডেকেছেন। আমি ষষ্ঠেন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করি, যে গুপ্তরহস্য জানতে চাই তা এখন আমার ধরাছোঁয়ার মধ্যে। যাওয়ার আগে তোমাকে জানাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু চিকিৎসকের সামনে সে চেষ্টা বৃথা! ভাবলাম তোমার ঘরের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময়ে দেখা হলে ইশারায় জানাবো! কিন্তু যাওয়ার সময় তোমাকে দেখতে পেলাম না!

আর কিছু করতে গেলে তুমি বিপদে পড়তে পারো ভেবে চুপচাপ ওই চিকিৎসকের সঙ্গে হেঁটে মন্দিরে ঢুকি। তাকে অনুসরণ করে মুর্তির পেছনের ভূগর্ভ পথ ধরে ওদের গোপন নিভৃত আবাস ওই সঙ্কীর্ণ মালভূমিতে। ওই সুড়ঙ্গ পথে আসার সময় চিকিৎসকের শরীরী ভাষা থেকেই মনে হয়, আর বোধ হয় সো সা লিং-এ ফেরার সুযোগ পাবো না! তুমিও কি ওই পথ ধরেই - ?

– হ্যাঁ, অনগের বর্ণনা অনুযায়ী ওই দামাল চাষা যুবকের অভিজ্ঞতার কথা মাথায় ছিল।

– আর কোনও পথ নেই। তুমি নিশ্চয়ই ওই সঙ্কীর্ণ মালভূমিতে সারি সারি সাধনাকক্ষগুলি দেখেছো! সেই রাতে সেরকমই একটি নিভৃত আবাসে আশঙ্কায় রাত কাটানোর পর সকালে মঠাধ্যক্ষ এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলে, কথা ঠিক নয়, জেরা করে বলতে পারো! ওই ভূতুড়ে লোকটাকে তুমি এক মোক্ষম আঘাতে মেরে ফেলেছ, সে ছিল একজঘণ্য জাদুকর, সম্মোহন বিদ্যার পারদর্শী। কিন্তু ওর সম্মোহন বিদ্যা আমার উপর খাটাতে না পেরে লোকটা নানাভাবে বশ করার চেষ্টা করতে থাকে। নিজের জীবনের সাফল্যের কথা শোনায়।

- কীসের সাফল্য? লোককে বোকা বানানোর?

- না, তার দাবি অনুযায়ী সে বেঁচে আছে এক হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে। সে কখনও ঘুমায় না। পঁচিশ বছর একনাগাড়ে জেগে থাকার পর ছ'মাসের জন্য ঘুমায়। আমি ভাবি, ওর কথা সত্যি হলে আমাদের রামায়ণের কুম্ভকর্ণের ছ'মাস ঘুমানোর কিংবদন্তীও সত্যি! তোমাকে তো রামায়ণের গল্প বলেছি! যাই হোক, ওই ছ'মাসের মধ্যে সে নাকি নিজের প্রাণশক্তি সম্পূর্ণরূপে ফিরে পায় এবং একজন সদ্য যুবকের মতন চনমনে স্বাস্থ্য নিয়ে পরবর্তী দিনগুলি কাটাতে শুরু করে।

এখন আমরা ওকে তেমনি একটি পঁচিশ বছরের শেষ ধাপে দেখতে পেয়েছি। আমি অনুভব করি, এবার ছ’মাসের ঘুমে যেতে সে ভয় পাচ্ছে। সে এত বছর ধরে যেভাবে বারবার মৃত্যুকে এড়িয়ে পূর্ণযৌবন ফিরে পেয়েছে এবারও তা পাবে কিনা সে বিষয়ে সন্দিহান হয়ে উঠেছে। সে মনে মনে জানে এই গুপ্তবিদ্যা ওর আয়ু বাড়ালেও অমরত্ব এনে দিতে পারেনি। মরতে তাকে হবেই। এবার ঘুমালেই যে আবার জেগে উঠতে পারবে সে বিষয়ে কোনও নিশ্চয়তা নেই। ওর ঘনিষ্ঠ অনুগামীরাও অনেকে এই অবিশ্বাস্য জীবনশক্তির উত্তরাধিকার পেয়েছে। যদিও মঠাধ্যক্ষের ধারে কাছে কেউ নেই, তবে শতাধিক বছর ধরে বেঁচে আছে তেমনি শিষ্যের সংখ্যা কম নয়। তারাও মরতে ভয় পায় এবং অমর হতে চায়।

এটুকু বলে রাম আবার হাঁপিয়ে ওঠে। সে পা টিপে টিপে ধারার কাছে গিয়ে ঝুঁকে এক অঞ্জলি জল খায়। তারপর ইশারায় গরবকে এগিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয়। গরব হেসে ওর হাত ধরে ধারার কিনার দিয়েই অরণ্যের পথে এগুতে থাকে। তবে রামের গতি শ্লথ থাকায় গরবও ধীরে ধীরে এগোয়।

রাম বলে, ওদের গুপ্তবিদ্যা, যে জঘণ্য বিদ্যা ওরা হাজার বছর ধরে সো সা লিং-এ চর্চা করে আসছে তা এখনও তাদেরকে সম্পূর্ণ অমরত্বের পথ দেখায়নি। ওরা এখনও কোনও চমৎকারের আশায় নানারকম গুপ্তসাধনা করে যাচ্ছে। তুমি দেখেছ, ওদের সর্বশেষ আবিষ্কৃত রসায়ন পেতে ওরা কী করতে পারে!

কিন্ত ওদের সমস্যা হল, কোনও মানুষকে মেরে ওখানে শুইয়ে দিলে ওদের কাজ হবে না। ওদের নিরীক্ষা অনুযায়ী, কোনও পূর্ণযুবককে স্বেচ্ছায় আত্মোৎসর্গের জন্যে রাজি করাতে হবে এবং যতক্ষণ না মারা যায় সেই ব্যক্তি আত্মোৎসর্গের কথাই ভাববে। কিন্তু জীবন্ত ওই নারকীয় অবস্থায় ওভাবে নরকযন্ত্রণা সহ্য করে আত্মোৎসর্গের চিন্তা করা হয়তো কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। সেজন্যে তাদের শরীর পচে যে রসায়ন তৈরি হয় তা বনদের জীবনীশক্তি বাড়ালেও অমর করে তুলতে পারে না। সেজন্যে,বনরা যুবকদের স্বেচ্ছায় আত্মোৎসর্গের জন্যে রাজি করাতে সম্মোহন বিদ্যা প্রয়োগ করে। আমার ক্ষেত্রে সেই সম্মোহন বিদ্যা সফল না হওয়ায় মঠাধ্যক্ষকে অনেক বেশি সময় ব্যয় করতে হয়। সে আমাকে বলে, আমার আত্মা নাকি ইতিমধ্যেই আমার দেহ ছেড়ে চলে গেছে, যে জীবনীশক্তি দেহটাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তা-ও নাকি শেষের পথে, প্রাকৃতিক নিয়মেই আমার মৃত্যু যে ঘনিয়ে এসেছে তা টের পেয়ে আমাকে পরবর্তী জন্মের জন্যে পুণ্য অর্জনের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।

গরব বলে, আরে, মঠাধ্যক্ষ আমাকেও তো একই প্রস্তাব দিয়েছিল।

রাম বলে, হ্যাঁ, ওরা হয়তো একসময় তোমাকেও আমার পাশে এনে শুইয়ে দিত!

গরব বলে, আমাকে প্রমাণ স্বরূপ চোখের সমান্তরালে হাত উঠিয়ে কব্জির দিকে তাকাতে বলে!

রাম হেসে বলে, আমাকেও তাই করতে বলেছিল!

গরব বলে, লোকটা মিথ্যেবাদী, আমি অনেকবার এমনি তাকিয়ে দেখেছি, আমার পুরো হাতই দেখা যায়, আঙুলগুলিও দেখতে পাই।

রাম বলে, আমিও ওর কথা বিশ্বাস করিনি। ভারতীয় দর্শন অনুযায়ী আত্মা চলে গেলে দেহ কখনো অবশিষ্ট প্রাণশক্তি চালিত হয়ে বেঁচে থাকতে পারে না। হিন্দু বৌদ্ধ জৈন সকল দর্শনই এই কথা বলে। কিন্তু আমি জানতে চাই - মৃত্যুর ওপারে কী? বেঁচে থাকা আর না থাকার সুক্ষ্ম সীমারেখাটা অনুভব করতে চাই। কিন্তু মঠাধ্যক্ষের কথামতন বারবার কব্জির দিকে তেমনি তাকিয়ে একসময় সত্যি সত্যি কব্জির পর হাত বিভক্ত হয়ে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখি! তাহলে আমি অচিরেই মারা যাবো . . . . আমি মৃতদেহ মাত্র!

– তুমি পাগল হয়েছ? তার মানে তুমি যতই বলো যে তুমি আত্মিক শক্তিতে বলীয়ান, তোমাকে সম্মোহন করা সম্ভব নয়; সেই গুমর ভেঙে দিয়ে মঠাধ্যক্ষ তোমাকে সত্যি সত্যি সম্মোহিত করতে পেরেছিল!

– না বন্ধু, আমি টের পেয়েছিলাম যে সো সা লিং-এর গুপ্তবিদ্যা পুরোপুরি জানতে চলেছি। কীভাবে স্বেচ্ছায় আত্মোৎসর্গ করলে একজনের জীবনীশক্তি অন্যে গ্রহণ করতে পারে তা জানার আগ্রহ সেদিন আরও প্রবল হয়ে ওঠে। সেজন্যেই সজ্ঞানে মঠাধ্যক্ষের কথায় রাজি হয়ে যাই। কিন্তু তখনও জানি না যে ওই সংকীর্ণ মালভূমির নিভৃত সাধনাস্থল থেকে আমাকে সেই নারকীয় শৈলান্তরীপে নিয়ে আসা হবে!

সেদিন রাতের আঁধারে ওরা মন্ত্র জপতে জপতে ধুপধুনো জ্বালিয়ে আমাকে ওই নারকীয় গুহায় নিয়ে আসে। গুহার দরজা খোলার আগেই ওরা আমার পোশাক খুলে নেয়। আমাকে নিয়ে ঢোকার পর লণ্ঠনের আলোয় প্রথম ওই নারকীয় দৃশ্য দেখি। আমাকে শোয়ানোর আগে শেকল ও তালা খুলে দেওয়ায় ওই শুন্যগর্ভ বেদিতে তখনও বেঁচে থাকা এক যুবক উঠে বসতে চায়, ওখান থেকে বেরুতে চায়। ওর পায়ে ও কোমরে কৃমিকীটেরা ঘুরে বেড়াচ্ছিলো। কিন্তু সে এতই অশক্ত হয়ে পড়েছিল যে কিছুই করতে পারে না। তা দেখে আমি হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইলে ওরা জাপটে ধরে আমাকে ওর পাশেই শুইয়ে দিয়ে মন্ত্র জপতে জপতে লোহার পাত চাপা দিয়ে শিকল টেনে তালা লাগিয়ে দেয়। তারপর মঠাধ্যক্ষ আবার আত্মোৎসর্গ এবং পরজন্মের জন্য পুণ্যার্জন নিয়ে কিছু কথা বলে তালা লাগিয়ে চলে যায়।

রাম একটু থেমে আবার বুকভরে প্রশ্বাস নিয়ে বলে, - আঃ, কী নির্মল বাতাস! আর আমি সেই পুতিগন্ধময় পরিবেশে মঠাধ্যক্ষের সম্মোহনে আবিষ্ট হয়ে বা নিজের ইচ্ছাতেই সেই বীর কদমে এগিয়ে আসা মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করতে থাকি। আমি ভাবি, এভাবেই জীবন ও মৃত্যুর সূক্ষ্ম সীমারেখাকে জেনে নিয়ে বিজয়ী হবো! পরদিন ওই গুহার দরজার ফাঁক দিয়ে এক চিলতে রোদ এসে আমার পাশে শুয়ে থাকা যুবকের মুখে পড়ে। সে কয়েকবার খাবি খাওয়ার পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আমার শরীরে স্পর্শ করে থাকা ওর পায়ে একটি তীব্র কম্পন হয়। আর তারপরই সে নিথর হয়ে পড়ে। আমি টের পাই যে এই রহস্যের সন্ধানে আমি অবধারিত মৃত্যুর ফাঁদে আটকে গেছি। এখান থেকে জীবনে ফেরার আর কোনও পথ খোলা নেই।

আর তখনই হঠাৎ তোমার কথা মনে পড়ে। আমি আকুলভাবে তোমার কথা, শুধু তোমার কথা ভাবতে থাকি। তোমার কথা ভেবে ভেবে আর যথাসম্ভব হাত পা নাড়ার চেষ্টা করেই সারাদিন কাটিয়ে দিই।

সেদিন সন্ধ্যায় মঠাধ্যক্ষ এসে প্রায় সারারাতই ওই গুহায় কাটায়। সে আমাকে অনেক কথা বলে। কিন্তু আমি ওঁর কোনও কথারই জবাব না দিয়ে শুধু যথাসম্ভব হাত পা নাড়ার চেষ্টা করে নিজের বোধশক্তির পরীক্ষা করতে থাকি। কিন্তু পরদিনই কৃমিকীটেরা পাশের যুবকটির শরীর থেকে ধীরে ধীরে আমার পায়ে ও গায়ে চলাফেরা শুরু করলে একটা বিভীষিকা আমাকে গ্রাস করতে শুরু করে এবং ক্রমে সে জয়ী হয়। ওই বিভীষিকাই আমার মনে তীব্র জিজীবিষা জাগিয়ে তোলে, আমি যে কোনওভাবে ওখান থেকে পালাতে চাই। ঈশ্বরের কাছে মুক্তির প্রার্থনা করতে থাকি। অবশেষে ঈশ্বর আমার কথা শোনেন, তোমার হাত দিয়ে ঈশ্বর আমার জীবন রক্ষা করেন!

ওর কথা শুনতে শুনতে গরবের চোখে জল চলে আসে। সজল চোখে গরব ওর পিঠ চাপড়ে বলে, এখন ওই বিভীষিকার কথা ভুলে যাও, সেটা এখন অতীত! এখনও আমাদের বিপদ কাটেনি। দাঁড়িয়ে পড়ো না! বিশ্বাস কর, লোকালয়ে পৌঁছে গেলে আর এত খারাপ লাগবে না! দীর্ঘ উপবাসে তোমার শরীরে এখন নানা উপাদানের অভাব তৈরি হয়েছে, তোমার গায়ে জ্বর জ্বর ভাব দেখে তাই মনে হচ্ছে! তার উপর এই পালানোর ত্রাস ও ধকল – একটু থেমে গরব আবার বলে, ভয় পেয়ো না, আমার কোমরে একটা ধারালো ছুরি আছে . . . আমি ডাকাত সর্দার ছিলাম, একসঙ্গে একাধিক শত্রুর সঙ্গে গেরিলা লড়াইয়ের কৌশল আমার জানা; এই বনদের আমি ভয় পাই না!

রাম আক্ষেপের স্বরে একবার নাভি থেকে ‘হো হো হো’ আওয়াজ তুলে বলে, সত্যি আমি কাপুরুষ!

একবার ঢোঁক গিলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, নিজেকে মনের দিক থেকে অত্যন্ত সবল ভাবতাম, কিন্তু হেরে গেছি, দুর্বল হয়ে গেছি। শব্দ, শব্দ, নানা শব্দ দিয়ে আমি নিজেকে বোকা বানিয়েছি। আর মাত্র কয়েকদিন অটল, অবিচল থাকলেই জয়লাভ করতাম, নিজেকে, আভ্যন্তরীণ সত্তাকে জানতে পারতাম! কে জানে, যাদেরকে পাশে শুয়ে থাকা কঙ্কাল ভেবেছি, যাদের পচা মাংসের পুতিগন্ধে বিচলিত হয়েছি, পাশে শুয়ে থাকা যে যুবকের শরীরের শেষ কম্পন আমার অস্তিত্বকে শিহরিত করেছে তারাই হয়তো জয়ী। তারা সবাই, অন্তত তাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো সেই গুঢ় রহস্য ভেদ করতে পেরেছে, বন তান্ত্রিকদের গুপ্তবিদ্যার কথা বলছি না, আমি বলছি রহস্যগুলির রহস্যের কথা –

একটি বিশাল আকারের পিকা ইঁদুর দৌড়ে ওদের সামনে দিয়ে চলে যায়। পেছন পেছন আরও দুটো। ওরা ছুটছে কেন? কেউ কি ধাওয়া করছে পেছন থেকে?

গরব কী ভেবে রামকে একটু জোরে হাঁটতে বলে। কিন্তু রাম বিন্দুমাত্র আগ্রহ না দেখিয়ে আর একবার বুক ভরে প্রশ্বাস নিয়ে জেদী কিশোরের মতন আওয়াজে বলে, গরব, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ, অনেক কষ্ট দিয়েছি, আমি আবার ফিরে যাব, ওই ঘরে আবার গিয়ে স্বেচ্ছায় শুয়ে পড়বো, এত সহজেই বিচলিত হয়ে চলে আসা উচিত হয়নি,এবার আমি এর শেষ দেখে ছাড়বো!

গরব চিৎকার করে ওঠে, ঈশ্বরের দোহাই রাম, পাগল হয়ো না!

রাম একথার কোনও জবাব দেয় না। সে থরথর করে কাঁপতে থাকে। দু-চোখ টকটকে লাল! গরব ওর কপালে হাত দিয়ে দেখে জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। গরব বুঝতে পারে ওই বিভীষিকা থেকে শারীরিকভাবে বেরিয়ে এলেও বিভীষিকা এখনও ওর পেছন ছাড়েনি। সে মানসিক বৈকল্যের শিকার। সে কী আদৌ শান্ত হবে!

সে কী কখনও বুঝতে পারবে যে দেরি হয়ে যাচ্ছে! যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে দূরে যাওয়া উচিত। ইতিমধ্যেই অনেক সময় নষ্ট হয়ে গেছে! গরব ধারার শীতল জল দিয়ে রামের মাথা ধুইয়ে দেয়। তারপর কাপড় ভিজিয়ে ভিজিয়ে ওর কপালে জলপট্টি দিতে থাকে, মুখ ও ঘাড় মুছে দিতে থাকে। কে জানে সে কখন সুস্থ ও সচল হবে।

কিছুক্ষণ পরই নিকটবর্তী জলপ্রপাতের শব্দ ছাপিয়ে জঙ্গলের ডালাপালা ' ভাঙার শব্দ শুনে গরব উৎকর্ণ হয়। সে ফিসফিস করে রামকে বলে, - ওঠো রাম, ওরা আসছে, সম্ভবত বনরা আমাদের খুঁজতে খুঁজতে এই জঙ্গলে পৌছে গেছে।

রাম চোখ না খুলেই বলে, আমিই ওদের মনে মনে ডেকেছি, যেমন গতকাল তোমাকে ডেকেছিলাম, তোমাকে এত কষ্ট দেওয়ার জন্যে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত গরব, এখন তুমি পালাও! আমাকে ওরা নিয়ে যাক! আমি ফিরতে চাই, আবার কঠিনতম পরীক্ষার মুখোমুখি হব এবং জিতব! আমাকে জিততে দাও গরব!

– চুপ কর! তুমি প্রলাপ বকছো! আমাদেরকে পেলে ওরা এখুনি মেরে ফেলবে!

গরব অনেকের কণ্ঠস্বর শুনতে পায় কাছে ও দূরে। সঙ্গে ম্যাস্টিফ কুকুরের ডাক। সে বুঝতে পরে একটু আগে পিকা ইঁদুর তিনটির ত্রস্ত ছোটাছুটির কারণ। একটা দল জঙ্গলে ঢুকেছে, আর অন্যরা ওরা পাহাড় থেকে গড়িয়ে যে তৃণভূমিতে এসে নেমেছিলো সেখানে দাঁড়িয়ে ওদের পায়ের ছাপ পরীক্ষা করছে। গরব ফিসফিস করে বলে, আর দেরি করলে ওরা আমাদের পেয়ে যাবে! এক্ষুণি পালানোর কোনও উপায় নেই, আমাদের এখন গিয়ে ওই জলপ্রপাতের পেছনে পাথরের আড়ালে লুকিয়ে পড়তে হবে! ওই প্রবল স্রোতধারা আমাদের লুকানোর জন্যে যথেষ্ট। শুধু মুখ জলের বাইরে বের করে রাখতে হবে। ভাগ্য ভাল থাকলে ওরা এত দূরে এত খুঁটিয়ে দেখার সুযোগ পাবে না!

গরব মরিয়া হয়ে রামকে পাঁজাকোলে তুলে নিয়ে দ্রুত ধারার বুকে জেগে থাকা বড়বড় পাথরগুলিতে পা রেখে রেখে অনেক কষ্টে জলপ্রপাতের পতনস্থলে পৌছে যায়। জলে বয়ে যাওয়া কয়েকটি পাতাঅলা গাছের ডাল হাতে নিয়ে দুজনের মাথা ঢাকে। তারপর জলপ্রপাতের পেছনে দুটো বড় পাথরের আড়ালে এক বুক জলে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে থাকে।

ততক্ষণে তল্লাশকারী প্রথম দলটি জঙ্গলের গাছের গোড়াগুলি খুঁজতে খুঁজতে ধারার কাছাকাছি চলে আসে। ওদের বেশভূষা দেখে গরব নিশ্চিত হয় যে ওরা সবাই মঠের সেবাইত। একজন তো কিছুক্ষণ আগে গরব আর রাম যে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে ছিল তার কাছাকাছি পৌঁছে যায়। আরে এ তো মিগমার! ওকে দেখে রাম আবার উত্তেজিত হয়ে বলে, আমি ফিরতে চাই – আমাকে যেতে দাও . . . . আমাকে প্রমান করতে দাও . . . . আমি জানতে চাই!

গরব এবার ভয় পেয়ে যায়। সে চাপা স্বরে ধমক দেয়, চুপ কর! এভাবে ক্ষ্যাপার মতন চেঁচালে ওরা শুনে ফেলবে!

রাম বলে, আমি তাই চাই . . . ওদের ডাকতে চাই . . . . এখানে . . . . আমি এখানে . . . . আমি!

রাম এক ঝটকায় নিজেকে গরবের শক্ত বাহুবেষ্টনী থেকে মুক্ত করে নিয়ে হাত তুলে চিৎকার করতে যায়। এক সেকেন্ডের মধ্যেই গরব ওকে ধরে ফেলে ওর মাথাটা জলে ঠেসে ধরে। জলের ধারার পাশে নুড়ি পাথরগুলির উপর এখন একাধিক জুতোর শব্দ। রাম তার সমস্ত শক্তি দিয়ে উঠে পড়তে চায় আর গরব আতঙ্কে ওর মাথাটা জলের নিচে চেপে ধরে থাকে।

তখুনি লোকগুলিকে ফিরে যেতে দেখে গরব রামের মাথা ছেড়ে দেয়। কিন্তু রাম আবার শরীর ছেড়ে দিয়েছে। গরব ওকে বুকে জড়িয়ে সোজা দাঁড় করায়। রাম ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। পলক পড়ে না। ঠোট হাঁ। গরব তাড়াতাড়ি ওকে পাথরের উপর তুলে পিঠে চাপ দেয়। ওর মুখ থেকে গলগল করে জল বেরিয়ে আসে। গরব ওর মুখে জোরে জোরে ফুঁ দেয়। বুকে চাপ দেয়। কিন্তু রাম আর নিঃশ্বাস ফেলে না। সে নিথর হয়ে পড়ে।

গরব অবাক হয়ে ডাকে, রাম রাম, হায় রাম! আমি কী করলাম!

সে কেঁদে ফেলে বিড়বিড় করে, এত কষ্ট করে, লড়াই করে, তোমাকে নরক থেকে উদ্ধার করে এনে নিজের হাতে মেরে ফেললাম বন্ধু?

সেদিন সারা দুপুর ও বিকেল গরব ওই পাথরে হেলান দিয়ে বসে থাকে। রামও তার মুখোমুখি অন্য একটি পাথরে হেলান দিয়ে ওর দিকে অবাক বিস্ময়ে ডাগর কালো বড় বড় চোখ দুটি মেলে তাকিয়ে থাকে — অপলক! গরবের মনে পড়ে লাসার সেই সন্ন্যাসীর দৈববাণী – অ - তল খা - দ!

গরবের দু’চোখ ছাপিয়ে দু’গাল বেয়ে জল গড়াতে থাকে অবিরাম। দুর্ধর্ষ ডাকাত সর্দার গরব কাঁদছে! মা আর প্রিয়তমা দেচমার পর গরব যাকে সবচাইতে বেশি ভালবেসেছিল সে এই রাম। বারবার বুক কাঁপিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে গরব, হায় রাম! হায় –

ধীরে ধীরে উপত্যকার বুকে অন্ধকার নেমে এসে ওর আর রামের মাঝে কালো পর্দা টাঙিয়ে দিলে গরব উঠে দাঁড়ায়।