বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৮, ২০২৪

মহাসত্যের বিপরীতে,পর্ব -৪


চার.

আলেকজান্দ্রার নায়ক

পানচুকের কাছে আলেকজান্দ্রা ডেভিড নীলের লেখা ইংরেজি উপন্যাস ‘টিবেটান টেল অব লভ অ্যান্ড ম্যাজিক’ বইটি দেখে অবাক সার্জের্ন্ট আলোক মিত্র। এই লেখিকার মেয়ে নাকি কয়েকবছর আগে হঠাৎ একদিন লবজাঙ্গ স্টোকডানের সঙ্গে ওদের গ্রামে এসেছিলেন। তিনি মায়ের লেখা উপন্যাসের চরিত্র সন্ধানে বেড়িয়ে তাদের বংশধরদের খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে ছিলিং পানচুক জানবাককে পেয়েছেন। খুশি হয়ে তিনি এই বইটি তাকে উপহার দিয়েছেন। ঠাকুর্দা গরব ও ঠাকুমা দেচমার প্রেমকাহিনী। পানচুক ভাল ইংরেজি জানে না। লবজাঙ্গ স্টোকডান পড়ে পড়ে তাকে গল্প শুনিয়েছে। উপন্যাসের শেষটার সঙ্গে ঠাকুর্দা-ঠাকুমার জীবনের কোনও মিল নেই। মনগড়া গল্প লিখেছেন মহিলা। এসব শুনে আলোকের মনে আগ্রহ জন্মায়। সে পানচুকের কাছে বইটি পড়তে চায়। পানচুক সঙ্গে সঙ্গে ওকে দিয়ে বলে, কিন্তু কাউকে দেবেন না স্যার, কপি নাই তো ! এই বইটা আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্য; সম্পদ। সাবধানে পড়বেন।

দু’দিন ঘোলা জল খাওয়ার পর বেস ক্যাম্পে তুষারপাত হওয়ায় সবাই খুশি ওরা। আজ ওরা স্বচ্ছ জল খাবে। আঙুলের ব্যথায় চিঠি লেখা বন্ধ। আবার রেডিও টেলিফোনির হ্যান্ডসেট আর আলেকজান্দ্রার উপন্যাসটি নিয়ে সে স্লিপিং ব্যাগে ঢুকে পড়ে। দু’দিন ধরে লিখেও আলোক একটা ইনল্যান্ড ভরতে পারেনি। একটা ইনল্যান্ড ভরতে একজন সৈনিকের কতটা সময় লাগে ! ও লিখে ফেলতে পারতো। কিন্তু গত পরশু সন্ধ্যায় বুখারি সাফ করতে গিয়ে ডান হাতের তর্জনী কেটে গেছে খানিকটা। ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্স থেকে ড্রেসিং করে এসেছে। একটা মাত্র সেলাই লাগাতে হয়েছে। কিন্তু ভীষণ যন্ত্রণা। ছিলিঙ পানচুক জানবাকের পাঁজর ও দু’হাতের কব্জিতে মোট একুশটা সেলাই লাগাতে হয়েছে। তখনও ওর জ্ঞান ফেরেনি। ওর অবস্থা দেখে আলোকের নিজের কষ্টকে তুচ্ছ মনে হয়।

গতপরশু ওকে নিয়ে চমরিগাইটা উর্দ্ধশ্বাসে ছুটতে শুরু করলে ঘটনাটা অনেকের নজরে পড়ে।সঙ্গে সঙ্গে খবর পৌঁছে যায় বেস কমান্ডারের কাছে। তৎক্ষণাৎ জিপ নিয়ে বেড়িয়ে পড়েন তিনি। সুবেদার মেজর তখুনি ওই দুই কাণ্ডজ্ঞানহীন সিপাহিকে ডিটেইন করে কোয়ার্টার গার্ডে আনার নির্দেশ দেন। অ্যাডজুটেন্টও প্রত্যক্ষদর্শী দুই সিপাহিকে সঙ্গে নিয়ে বেস কমান্ডারের সঙ্গে জিপে ওঠেন।

বেস কমান্ডার চোখে দূরবীন লাগিয়ে একসময় দূরে নুব্রা নদীর ধারে চমরি গাইটাকে ডিগবাজি খেতে দেখেন। কিছু দূর গিয়ে তাই জিপ থেকে নেমে পড়তে হয়। পেছন-পেছন রিকভারি ভ্যানটাও থেমে যায়। নেমে আসে আরও জনা বিশেক সৈনিক। ওরা চমরি গাইটাকে আবার উঠে ছুটে পালিয়ে যেতে দেখে। বেস কমান্ডার ও অন্য সবাই শুকনো কাঁটাগাছের ঝোঁপ আর বিশাল বিশাল পাথরের চাঁই পেরিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই নুব্রার তীরে পৌঁছে যায়। অচৈতন্য যুবকটিকে স্ট্রেচারে তুলে দু’জন সৈনিক প্রায় ছুটতে ছুটতে একে রিকভারি ভ্যানে ওঠায়।

ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে এলে রক্তাক্ত পোর্টারকে দেখতে আসা অসংখ্য সাধারণ সৈনিক হা-হুতাশ করতে থাকে। ওই দুই বর্বর মাতালকে গালি দিতে থাকে সবাই। কোনওরকম চার্জ-ট্রায়াল ছাড়াই বেস কমান্ডার আদেশ দেন ওদেরকে একমাস বালির বস্তা পিঠে চাপিয়ে সকাল-বিকাল নিয়ম করেকোয়ার্টার গার্ডের চারপাশে চক্কর লাগাতে হবে রোজ। বেস কমান্ডারের উত্তেজিত আদেশে সবাই নিশ্চুপ। রাগে গরগর করতে করতে তিনি মেডিক্যাল অফিসারকে বলেন প্রতি ঘন্টায় ছেলেটার স্বাস্থ্যের খবর জানাতে।

ছিলিঙ পানচুক জানবাককে হাসপাতালে আনার এক ঘন্টা পরই আলোকের হাত কাটে। ঘটনাটা ওকে খুব ভাবিয়েছে। মানুষ এত নৃশংস হয় কি করে ! বিনা প্ররোচনায় একজন নির্দোষ ব্যক্তিকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারে ! তোদের মাংস খাওয়া এতই জরুরী? ভাবতে ভাবতে বুখারির নলের কোণ লেগে হাতটা কাটে। সঙ্গে সঙ্গেবিলেটে ঢুকে সাবান ও গরম জল দিয়ে ধুয়ে ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্সে যায়। পানচুকের তখন জ্ঞান ফিরেছে। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। মালটিপল ফ্রাকচার আর এতোগুলি সেলাই দেখে আলোকের মাত্র একটা সেলাই নিতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হয়নি। এখনও ঠান্ডায় থাকলে এতটা যন্ত্রণা হয় না। স্লিপিং ব্যাগে ঢুকলে বা বুখারির কাছে বসে লিখলে উত্তাপে যন্ত্রণা বাড়ে। আলোক তাই আজ সকালে পানচুকের দেয়া বইটি নিয়ে স্লিপিং ব্যাগে ঢোকে। পানচুক এখনও নিজে উঠে বই বের করে দেওয়ার মতন অবস্থায় নেই। ওর অনুরোধে আলোকই ওর রুকশ্যাক থেকে বইটা বের করে। তারপর ওর সঙ্গে কথা বলতে বলতে পানচুক ওকে উপন্যাসটি পড়ার জন্য দেয়।

ভূমিকায় আলেকজান্দ্রা লিখেছেন, তিব্বতের দাইশিন প্রদেশের পথে কয়েকদিনের জন্য আমি আর লাসা ইয়ংডেন একজন ধনী সর্দারের বাড়িতে ছিলাম। দিগন্তবিস্তৃত কৃষিজমি ছাড়াও অসংখ্য ভেড়া ও মেষের মালিক তিনি। আমরা শুধু একরাতই বিশ্রাম নেব ভেবেছিলাম। কিন্তু ভদ্রলোকের মধুর ব্যবহার, আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে কয়েকদিন থেকে যাই। তাছাড়া আমার ধর্মপুত্র লামা ইয়ংডেন খাগইউড-কর্মপা বংশের মানুষ শুনে সর্দার ওকে প্রেত পুজোর অনুরোধ জানায়। সেজন্য পঞ্জিকা অনুযায়ী পুণ্যলগ্নের অপেক্ষায় আমাদের কয়েকদিন থাকাটা জরুরি হয়ে পড়ে।

খাগইউড-কর্মপারা তিব্বতের প্রাচীনতম বৌদ্ধ। এদের প্রাচীন গুরু হিন্দু তিলোপা ভারতে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা অধ্যাপক ছিলেন। এছাড়া পন্ডিত নারোপা, তাঁর শিষ্য মারপা আর মারপার শিষ্য কবি মিলারেপার অনুগামী খাগইউড-কর্মপাদের পূর্ব পুরুষরা। মারপা আর মিলারেপা অবশ্য তিব্বতি ছিলেন। এদের ধর্ম শিক্ষা গুরু থেকে শিষ্যদের মধ্যে প্রচারিত হয়ে আসছে দু’হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে।

ডাম্মা ডুলকু গরব এহেন একজন খাগইউড-কর্মাপাকেই কেন প্রেত পুজোর অনুরোধ জানাল, তা আমি কয়েকদিন পর বুঝতে পারি। সর্দার বেশ রাশভারী। সাধারণ তিব্বতীদের তুলনায় দীর্ঘদেহী ও বেশ স্বাস্থ্যবান। পেশীবহুল পেটানো স্বাস্থ্য। গায়ের রঙ আর আয়ত চোখ দু’টি দেখে বোঝা যায় তার জিনে আর্যপ্রভাব রয়েছে। আর একটি অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করলাম, লোকটি পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে মাঝেমধ্যেই থমকে দাঁড়িয়ে দূরবর্তী কিছু দেখে তাকিয়েই থাকে- জানি না কি দেখে। ওই এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ ও নিসর্গ এত সুন্দর মনোরম ও সম্মোহক যে আমিও ওর মতন হঠাৎ দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে প্রকৃতি দেখতে থাকি। কিন্তু ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে কোথাও কিছু দেখতে পাই না। মাঝেমধ্যেই তাকে আমি পদ্মাসনে বসে ধ্যান করতে দেখি। ঘন্টার পর ঘন্টা পদ্মাসনে ঠায় বসে চোখ বুজে থাকে। অবাক হই। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা ছাড়া তিব্বতে কাউকে এভাবে বসে থাকতে দেখা যায় না। এসব দেখে আমি জিজ্ঞেস করি, আপনি কি এখানকার আদিবাসিন্দা?

গরব আমার প্রশ্ন শুনে খুশি হয় না। গম্ভীর আওয়াজে জবাব দেয়, আমার জন্ম দক্ষিণে, এনগারি এলাকায়। হিমালয়ের পাদদেশে একটি বিস্তৃত প্রদেশের নাম এনগারি। ওই এলাকার অনেক মানুষ প্রায়ই জীবিকার সন্ধানে ভারত ও নেপাল যায়। ভারতীয় ও নেপালীদের সঙ্গে বিয়ের ফলে সেখানকার অনেক পরিবারেই গরবের মতন দীর্ঘদেহী, টিকালো নাক ও বড় চোখের নারী-পুরুষকে দেখা যায়। এত দূর থেকে এসে সে কিভাবে এই দাইশিন প্রদেশে এত সম্পদশালী হয়ে উঠল, তা জানতে আগ্রহ হয়। কিন্তু আমার প্রথম প্রশ্ন শুনে সে খুশি না হওয়ায় আমি তাকে আর কোনও প্রশ্ন করিনি।

একদিন সন্ধ্যায় আমার ভ্রমণসঙ্গী ও ধর্মপুত্র লামা ইয়ংডেন সর্দারের তাঁবুর সামনে বসে ওঁর সঙ্গে ৎসাম্পা খাচ্ছিলাম। সূর্যাস্তের পর তখন ধীরে ধীরে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। হঠাৎ আমরা সর্দারকে সচকিত হয়ে কান পেতে কিছু শুনতে দেখি। তারপর আমরাও দূর থেকে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ শুনতে পাই। গরব বলে, ঘোড়াটি ক্লান্ত, ওটার পিঠে অনেক ভার, তিব্বতী ডোকপা চাষীরা এরকম দূর থেকে আসা প্রাণীর খুরের আওয়াজ শুনেই বলে দিতে পারে, ওটি একাই পালিয়ে আসছে নাকি ওটার পিঠে মানুষ রয়েছে।

কিছুক্ষণ পরই একটি ঘোড়া আমাদের সামনে এসে থামে। একজন সুদর্শন যুবক ঘোড়া থেকে নেমে সঙ্গিনী যুবতীকে হাত ধরে নামতে সাহায্য করে। ঘোড়াটা দরদর করে ঘামছে। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। যুবকটি সর্দারকে বলে, আমার দু’টি তেজি ও স্বাস্থ্যবান ঘোড়া চাই। আমারটা আপনার কাছে রেখে যাব, এটি দামি নবীন ঘোড়া, দুয়েকদিন বিশ্রাম নিলেই এ সুস্থ হয়ে উঠবে। অতিরিক্ত কত টাকা লাগবে বলুন।

গরব বলে, এ নিয়ে আমরা কাল সকালে কথা বলবো। এখন রাত নামছে। খেয়ে দেয়ে বিশ্রাম নিন। আপনার ঘোড়াকে আমার লোক সুস্থ করে তুলবে।

যুবকটি বলে, - ধন্যবাদ, কিন্তু আমাদের এক্ষুণি চলে যেতে হবে!

সর্দার ওদের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালে, যুবকটি ঢোঁক গিলে আবার বলে, - পেছনে একদল ধাওয়া করছে, এক বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছি, অনেক দূ-র, সারারাত ঘোড়া চালালে তবেই পৌঁছুতে পারবো।

একটু থেমে সে আবার বলে, - আমরা পালাচ্ছি, ওর ইচ্ছেতেই ওকে নিয়ে পালাচ্ছি।

গরব এবার গম্ভীরভাবে মেয়েটিকে ভাল করে দেখে জিজ্ঞেস করে, - তুমি নিজের ইচ্ছায় যাচ্ছো? তুমি চাইলে এখানে থেকে যেতে পারো, কোনও ভয় নেই।

মেয়েটি ওর প্রেমিকের হাত ধরে ওর সংলগ্ন হয়ে বলে, - আমিও ওর সঙ্গেই যেতে চাই!

গোধুলির আলোয় ওই ঘর্মাক্ত প্রেমিক যুগলকে দেখে আমার দয়া হয়। গরব বলে, - ঠিক আছে, বুঝেছি, তোমরা এসে বসো। জল আর চা খাও। ততক্ষণে আমার লোক দু’টো ঘোড়া বেছে তৈরি করে আনুক।

গরব একজন অনুগামীকে ডেকে কেমন ঘোড়া লাগবে, তা বুঝিয়ে দেয়, আর অন্যজনকে ওদের জন্যে চা-জল খাবার আনতে বলে। অনুগামীরা দৌড়ে বাড়ির ভেতর চলে যায়।

প্রেমিক যুগল চা-জল খাবার খেয়ে শেষ করার আগেই দু’টো তাগড়া ঘোড়া এনে হাজির করে একজন। গরব ওই দু’টো ঘোড়ার পিঠে যথেষ্ট শুকনো খাবারও দিয়ে দিতে বলে। অবাক হয়ে দেখি গরবের অনুগামী ভৃত্যরা কত নিঃশব্দে যন্ত্রের মতন দ্রুত কাজগুলি করছে। এই দেখে আমার মনে একটা সন্দেহ দানা বাঁধে। এই পেশাদারীত্বের পেছনে রহস্য কী? নিজের জন্মভূমি থেকে এত দূরে এই সমৃদ্ধির পেছনে রহস্য নিছকই চাষবাস ও পশুপালন? নাকি অন্য কোনও অবৈধ ব্যবসা !

ঘোড়া দু’টির কাছে গিয়ে কেশরে সন্তান স্নেহে হাত বুলিয়ে আদর করে দিয়ে গরব বলে, সব চাইতে তেজি দু’টো ঘোড়া দিলাম, সারারাত ছোটাও, যত জোরে খুশি।

যুবকটি জিজ্ঞেস করে, আপনাকে কত টাকা দেব?

গরব বলে, - এক টাকাও না। যে ঘোড়াটা তুমি ছেড়ে যাচ্ছ সেটি খুব দামি। আমি দেখলেই বুঝতে পারি। এটির বদলে তোমাকে একটা ভাল ঘোড়া দিলাম। আর দ্বিতীয়টি ওটার যমজ। আমার পক্ষ থেকে তোমার প্রেমিকাকে ওটা উপহার দিলাম। তোমাদের দাম্পত্য জীবন সুখের হোক, আনন্দে কাটুক!

যুবকটি বলে, - আপনাকে ধন্যবাদ জানানোর ভাষা জানা নেই। কৃতজ্ঞতায় ওর ও মেয়েটির চোখ ছলছল করে ওঠে। আমিও আবেগতাড়িত হই।

গরব এবার অভিভাবকসুলভ গলায় ছেলেটিকে বলে, - যাও, এখন তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাও। ঈশ্বর তোমাদের সহায় হোন!

এক মিনিটের মধ্যেই ওরা ঘোড়ার পিঠে চেপে বসে। সর্দার বলে, - ঘোড়ার পিঠে থলেতে খাবার আছে, ক্ষিদে পেলে খেও!

আগন্তুক দম্পতি এবার যে যার ঘোড়ার পেটে পায়ের গোড়ালি ঠেকাতেই এক পা-দু’পা চলতে চলতে ঘোড়া দু’টি ছুটতে শুরু করে। তিব্বতি অশ্বচালকরা ঘোড়াকে এত ভালবাসে যে কেউ জুতোর গোড়ালিতে নাল ব্যবহার করে না। দেখতে দেখতে এই হবু নবদম্পতি ঘোড়া চালিয়ে দিগন্তের দিকে ছুটে যায়। এখন সেখানে আকাশের তারারা খুশিতে পৃথিবীর মাটিতে চুমু খায়। পৃথিবী শিহরিত হয়।

সমস্ত মালভূমিতে আবার প্রশান্তি বিরাজ করে, শীতল হাওয়া বয়। গরবের অনুগামীরা ততক্ষণে উঠোনে থেকে একটু দূরে খড়কুটো আর শুকনো লাকড়ি কোটা জড়ো করে আগুন ধরিয়েছে। গরব এবার সেই আগুনের পাশে গিয়ে বসে আর ক্রমে কীসের চিন্তায় বুঁদ হয়ে যায়। আমি তার পৌরুষদীপ্ত মুখে নানারকম অভিব্যক্তি দেখতে পাই আর লোকটাকে বুঝতে চেষ্টা করি। আমি আর লামা ইয়ংডেনও ওই আগুনের পাশে গিয়ে বসি। তখন গরব হাঁক দিয়ে একজন অনুগামীকে মদ আনতে বলে। সে পরপর কয়েক বাটি মদ খায় আর তারপর থম হয়ে বসে থাকে নির্বিকার। আমরাও চুমুক চুমুক মদ খাই। একটা কথা গরবকে না জিজ্ঞেস করে পারি না, - সম্পূর্ণ অচেনা এক দম্পতিকে এত দামি ঘোড়া এমনি উপহার দিলেন?

গরব কিছুক্ষণ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অস্ফুট স্বরে বলে, - এভাবে আমিও ছুটেছি অনেক, প্রেমের জন্যে ছোটাই তো আসল জীবন ম্যাডাম!

তরপর আবার নিঝুম নিস্তব্ধতা। আগুনে কাঠ ফাটার সামান্য আওয়াজ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। আমি ভাবি, এই শীতল প্রান্তিক মানুষটি এভাবে কেন ছুটছে? কোনও প্রেম কথা? ...একটি নাটক? এই বিপদগ্রস্থ হবু-দম্পতির প্রতি গরবের হঠাৎ এত আবেগ কিসের জন্য? আমাকে অবাক করে দিয়ে গরব এবার বলতে শুরু করে।

এ যেন কোনও মানুষের জীবন নয়- একটি অমর প্রেমকথা!

আলেকজান্দ্রা ডেভিড নীলের বইটি প্রায় দু’দিনে পড়ে ফেলে ভারতীয় বিমানবাহিনীর আবহাওয়া কর্মী সার্জেন্ট আলোক মিত্র। সে বোঝে, এহেন আবেগঘন এক ডাকাত সর্দারের পক্ষেই সম্ভব চীনের বিখ্যাত লাল ফৌজের শক্তিকে উপেক্ষা করে তাঁদের ধর্মগুরুকে পাহারা দিয়ে দীর্ঘপথ অতিক্রম করে ভারতে পৌঁছে দেওয়া ! সে কোথায় যেন পড়েছে ১৯৫৯-এর ১০ই মার্চ চিনের হাতে বন্দি হওয়ার ভয়ে তিব্বত থেকে পালিয়ে এসেছিলেন বৌদ্ধ ধর্মগুরু দলাই লামা। তাঁকে পালাতে সাহায্য করার অপরাধে প্রায় ১০ হাজার মানুষকে চীনা সেনারা গুলি করে মেরেছিল বলে অভিযোগ। কিন্তু সেসব নিরীহ মানুষ কিছুই জানতেন না।

ডাকাতসর্দার গরব তার দলবল নিয়ে নবীন ধর্মগুরুকে নতুন দেশে নিয়ে আসে। দলাই লামা ও তাঁর ঘনিষ্ঠ অনুগামীদের জন্যে এদেশ নতুন হলেও গৌতম বুদ্ধের দেশ বলে কথা।

গরব তখন হয়তো এ দেশকে নিজের দেশ বলেই ভাবতে শুরু করেছিল।

পানচুককে বইটি ফিরিয়ে দেওয়ার আগে আলোক বইটি আরেকবার পড়বে বলে ঠিক করে। এবং তারপরও সম্ভব হলে সে দ্রুত আলেকজান্দ্রার লেখা অন্য চারটি বই পড়বে। ‘মাই জার্নি টু লাসা’, ‘দ্য সিক্রেট ওরাল টিচিংস ইন টিবেটান বুদ্ধিস্ট সেক্টস’, ‘উইথ মিস্টিকস্ অব ম্যাজিশিয়ানস্ ইন টিবেট’, এবং ‘দ্য সুপার হিউম্যান লাইফ অব গেসার লিং’। আলেকজান্দ্রা ডেভিড নীল ওকে তিব্বত সম্পর্কে আরও আগ্রহী করে তুললেন। আলোক মনে মনে লেখিকাকে প্রণাম জানায়। প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে পূর্ববর্তী দলাই লামার জীবৎকালে পায়ে হেঁটে হেঁটে তিব্বতের নানাপ্রান্তে ঘুরেছেন এই মহিলা। আলোক তিব্বত যাবে বলে ঠিক করে। কিন্তু কেমন করে? ভাবতে ভাবতে আবার সে গরব-দেচমা প্রেমকথায় ডুব দেয়। আলেকজান্দ্রার নায়ক গরব আলোকের মননে মহাকাব্যের নায়ক হয়ে ওঠে।


লেখক পরিচিতি ঃ শ্যামল ভট্টাচার্য , আশির গোড়া থেকেই ত্রিপুরার একজন উল্লেখযোগ্য গল্পকার রূপে উঠে আসেন । ক্রমশ ত্রিপুরার গণ্ডি ছাপিয়ে সর্ব ভারতে ছড়িয়ে পরেন তাঁর স্বভাবজাত প্রতিভার স্বপ্রকাশে । একাধিক ভাষাবিদ কথাসাহিত্যিক শ্যামল ভট্টাচার্য ভারতীয় কথা সাহিত্যে সহজেই নিজের আসন পাকা করে নেন । উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ –‘চিলতে দাগ’, ‘ফুলমতির বসন্তকাল’,জামিছলঙ’,’ভারোং পাখির নাচ’,’Paisley’ এবং আকাশে ওড়ার গল্প’। তাঁর অনন্য উপন্যাস ‘বুখারি’র জন্য ২০১৫ সালে ‘ত্রিবেণী সাহিত্য আকাদেমি’, জলন্ধর কর্তৃক ‘অমৃতা প্রীতম সম্মান’-এ ভূষিত হয়েছেন । ‘লোদ্রভার কাছাকাছি’ উপন্যাসের জন্য ২০১০ সালে তিনি লাভ করেন ‘পশ্চিম বংগ বাংলা আকাদেমি পুরষ্কার’ । পাঞ্জাবী কথাসাহিত্যিক মোহন ভাণ্ডারির ,’মুন দী আঁখ’-এর অনুবাদ’কুমারী হরিণীর চোখ’( ২০০৭ ) অনুবাদ করে ২০১১ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরষ্কার লাভ করেন । অনুবাদ করেছেন একাধিক ভাষা থেকে । ‘মহাসত্যের বিপরীতে’ – চলছে তিব্বতিদের অস্তিত্বের সংকট ও জীবন যুদ্ধের সুদীর্ঘ লড়াই এর উপর ভিত্তি করে তিন প্রজন্ম নিয়ে এপিক উপন্যাস ...


চলবে ...