বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৮, ২০২৪

মহামারি এবং ...

.লেখক পরিচিতি -- ডঃ আক্রাম হোসেন একজন তরুণ অধ্যাপক ও গবেষক ।

একই সঙ্গে বিশ্বের সর্বাধিক লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো ঘটনা এপর্যন্ত খুব বেশি ঘটেনি। দুটি বিশ্বযুদ্ধের পর করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ নিসন্দেহে বিশ্ববাসীর মনে সর্বাধিক ত্রাস সৃষ্টি করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেবিভক্তিত মানুষ দম্ভ এবং শক্তি পরীক্ষায় বিপর্যয় নামিয়ে এনেছিল। জয় পরাজয়ের হিসাব মেলাতে মৃত-হতাহতের সংখ্যা গণনা করা হয়েছিল।যদি বলি সেই সব আসলে রাজনৈতিক ঘটনা। তাহলে এটাও সত্য- এই ঘটনাবলির প্রভাব মানব জাতিকে অবিভক্ত করতে সক্ষম হয়নি। বার বার মানব জাতিকেবিভক্ত করেছে। এবারের এই মহামারি (করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ) কি মানব জাতির উপর কোনো সদর্থক প্রভাব ফেলবে ? - নাকি এর পরও মানব জাতির একটা বড় অংশ মানবতাবোধ থেকে বহু যোজন দূরে থেকে নিজের অবস্থান অনড় রাখবে ! এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে আমরা কিছু অন্য কথা বলে নেবো।
সময়ে সময়ে ঘটে চলা বিভিন্ন ঘটনাবলি ভারতীয় সংস্কৃতিতে আঘাত হেনেছে। 'ভারত-সংস্কৃতি সমুদ্র বিশেষ' - এতে মিশে রয়েছে বিভিন্ন সংস্কৃতির স্রোতধারা। 'ভাষা-মনীষী' সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় ১৯৫২ সালে ২৫ জুলাই 'ফরহঙ্গ-ই-রব্বানী' নামে একটি উর্দু-বাংলা অভিধানের ভূমিকায় বলেছেন, " কোনো নির্দিষ্ট জাতীয় সংস্কৃতি সৃষ্টি হয় আন্তর্জাতিক মিলন, বিরোধ এবং শেষটায় মিশ্রনের ফলে।" খ্রিস্টান অখ্রিস্টানমিলে যেমন খ্রিস্টান সংস্কৃতি। ঠিক তেমনি হিন্দু-অহিন্দুর 'ভাব-সম্পদ' এবং 'উৎকর্ষতা' মিলে হিন্দু সংস্কৃতি তথা ভারতীয় সংস্কৃতি। এই অংশে ভাষা-মনীষীকে পুনরায় স্মরণ করছি, "আধুনিক ভারতীয় সভ্যতা হইতেছে এক নতুন যুগের সভ্যতা, মুসলমান প্রভাব যাহার মধ্যে ওতপ্রোতভাবেবিদ্যমান রহিয়াছে।" সম্প্রতি 'দেশ' পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক আবুল বাশার বলেছেন,

  • " হিন্দু-মুসলমান এক ব্যাপক সমন্বয়ে ও অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়িত-এই বন্ধন ছিন্ন করা পাপ।" ভারতীয় সংস্কৃতিতে মিশ্রিত ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম হলো মানুষের ব্যক্তিগতপালনীয় বিষয়। রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক থাকা উচিত নয়। আর যদি সম্পর্ক রাখার চেষ্টা করা যায় তাহলেই হয়ে যায় গড়বড়। ভারত এবং তুরস্কের মতো ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রেরপক্ষে এটা বড়ো ক্ষতিকারক বিষয়। স্বামী বিবেকানন্দের বিবেকবান ধর্ম, সূফী ফকিরদেরমানব প্রেম কিংবা বাউল ফকিরদের উদার ধর্মবোধ ভারতীয় সংস্কৃতিরক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর।এই অংশে উদাহরণ হিসাবে একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলছি, যা হয়তো অনেকের অভিজ্ঞতার সঙ্গেই মিলবে-গত দুর্গা পূজায় দেখলাম দেবীর আগমন সেলিব্রেশন করতে গিয়ে একটি মুসলিম মেয়ে দেবী সেজে স্কুলের মাঠে অসুর বধ করলো। ছোট বেলায় হিন্দু- অহিন্দু সবাই মিলে রথ টেনেছি -এসবের মধ্যেই তো লুকিয়ে রয়েছে ভারতীয় সংস্কৃতি। রবি ঠাকুর তো বড়ই হয়েছেন দর্জি নিয়ামত খলিফার তৈরি করা কাপড় পরে।


রাজনীতি অনেক ক্ষেত্রেই ভারতীয় সংস্কৃতিতে আঘাত করেছে। মানুষকে বিভক্তিত করেছে। সেই বিভাজন কখনো সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে, কখনো বা বর্ণের ভিত্তিতে আবার কখনো বা বিত্তের (শ্রেণি) দিক থেকে। দিল্লী হিংসা ভারতবর্ষের রাজনীতির অন্তিম দশকেই নির্দেশ করে, যা ভারতবর্ষের সত্ত্বায় আঘাত করেছে। দুটি বিশ্বযুদ্ধ থেকে মানব জাতি বিশেষ কিছু শিক্ষালাভ করতে সক্ষম না হলেও এঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়া অতি প্রয়োজনীয়। ভারতীয় রাজনীতির অস্থি-মজ্জা সার এই দশার পুনরাবৃত্তি মানব জাতির কাছে কাম্য নয়। করোনা সংক্রমণের এই ভয়াবহতা সমগ্র মানব জাতিকে স্থবির করে দিয়েছে। সারা পৃথিবীর জুড়ে ত্রাস সৃষ্টি করেছে। রাসায়নিক বিক্রিয়া বা দূষণের ফলে কিংবা দুর্বৃত্ত মাছ ভর্তি পুকুরে বিষ ঢেলে দিলে মাছেদের জীবনে যে সংকট নেমে আসে সমগ্র মানব জাতি যেন আজ অনেকটা তেমনি ঘটনার সম্মুখীন। এই মহাসংকটের সময় রাজধানীর রাজপথে দরিদ্র শ্রমিকদের মৃত্যু ভয়কে উপেক্ষা করে ঘরে ফেরার মিছিল ভারতবর্ষের বিত্ত বৈষম্যকেই নির্দেশ করে। অথচ করোনার মতো মহামারীর কাছে এসবই মিথ্যা। স্পেনের রাজকন্যা, ইজরাইলের প্রধানমন্ত্রী, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী কিংবা রাজপুত্র আর ফুটপাথের বিনিদ্র রাত যাপন করা মানুষ সবাই যে সমান তা প্রমাণিত। প্রাণী জগতের সমগ্র মানব জাতিটাই আজ সংকটের মুখোমুখি।পশুপাখিরা সংক্রমণ মুক্ত। তারা নিজের মতোই চলছে। বরং মনে হচ্ছে তারা আজ অনেকটা স্বস্তি বোধ করছে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় দেখা যাচ্ছে হরিণ, হাতি, পেঙ্গুইন প্রভৃতি বিভিন্ন ধরণের প্রাণীরা রাস্তায় ঘোরাফেরা করছে। ফাঁকা সমুদ্র সৈকতে কচ্ছপদের ডিম দেওয়ার চিত্রও কোথাও কোথাও ক্যামেরা বন্দি হয়েছে। পৃথিবী জুড়ে মন্দির-মসজিদ-গির্জা সহ সমগ্র ধর্মীয় প্রতিষ্ঠায় আজ প্রায় বন্ধই বলা যায়। নিঃস্বার্থ ভাবে কিছু মানুষ কেবল মানুষের হয়ে কাজ করে যাচ্ছে। স্বাস্থ্যবিভাগ থেকে বার বার ঘোষণা করছে করোনার সংক্রমণ মোকাবিলায় সবাইকে অংশগ্রহণ করার কথা। সরকারি নির্দেশ সব জায়গার সব মানুষকে সমানভাবে মেনে চলার কথা বলা হচ্ছে। অর্থাৎ সমস্ত মানুষ আজ সমান। সমস্ত মৃতদেহকে পর্যন্ত একই ভাবে একত্রে রাখা হচ্ছে। সমগ্র মানব জাতি যে একটাই জাতি তা আজ আর একবার সবার কাছে স্পষ্ট। লালনের কয়েকটি লাইন তুলে ধরে করোনা সংক্রমণের ভয়াবহতা থেকে ভারতবর্ষ তথা বিশ্ববাসীর মুক্তি কামনা করে শেষ করছি-


যখন তুমি ভবে এলে
তখন তুমি কি জাত ছিলে?
কি জাত হবা যাবার কালে
সে কথা কেন বল না?


---------


লেখক
ডঃ আক্রাম হোসেন
অধ্যাপক , কোকরাঝার DIET কলেজ
আসাম
ফোন ৮২৫০৮০৬৮৮১