শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪

ভারতবর্ষ,পর্ব -৬

পাঁচ

প্রদীপ ওপর থেকে নেমে এল। আমার সঙ্গে হাঁটাহাটি করতে করতে জানাল ইতিমধ্যে একদিন এলটিটিই রা এসে তাণ্ডব করে গেছে এখানে। না হামলা করে নি তবে ঢুকতে চেষ্টা করেছিল এই রাস্তা দিয়ে।

এবার এলাম তখন বিকেল বিকেল। অন্ধকার নামার সময় হতে এখনো দেরি তাও আঁধার হয়ে রয়েছে চতুর্দিশা যার তিন দিশায় সমুদ্রআর পেছনের দিকটা খুলছে পশ্চিমে। আকাশ ভারি মেঘে গম্ভীর। প্রদীপ দ্রুত নেমে এল বালিয়াড়ির পাহাড় থেকে আজ কেন এসেছেন? কাল রাত থেকে ওযার্নিং দেওয়া আছে বিশাল সাইক্লোন আসছে। আজ মধ্যরাত পর্যন্ত আছড়ে পড়বে উপকূলে। এক্ষুনি ফিরে যান। আজ অনেক ট্যুরিস্টদের ও ভীড় জমেছেল। সবাইকেইফেরানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল প্রদীপ। আমরা গাজীর মুখ ফেরাচ্ছি , ততক্ষণে দেখে নিচ্ছি কত উত্তাল হয়ে উঠেছে সমুদ্র।আমরা ফিরে আসব ততক্ষণে দৌড়ে এলো প্রদীপ। আর একটু থাকুন। হঠাত্ই কথাটা মাথায় এলো। প্রদীপ কেন বলেছিল আমাকে ধনুস্কোডি নিয়ে যাবে যখন সে জানে জায়গাটায় এলটিটিই রা আড্ডা গেড়েছে। ওর জন্য তো জাযগাটাও বিপজ্জনক ই। কিন্তু পরে যখন থেকে এলটিটিই প্রদীপদের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স এর ক্যাম্পএ এসে তামিলনাড়ুতে ঢুকতে চেষ্টা করেছে ততক্ষণ প্রদীপ ও সম্ভবত অত সচেতন থাকে নি এলটিটিইর ব্যাপারে। এদিকে জীবনযাত্রা চলছে সহজভাবেই। প্রচুর মাছ চলে আসছে ধনুস্কোডি থেকে তামিলনাড়ুর বাজারে। এই সব তটবর্তী শহরগুলিতে প্রচুর মাছ আসে কিন্তু বাজার এখানে নয। এই সামুদ্রিক পণ্য এখান থেকেই সত্বর চলে যায় মাদুরাই, ত্রিচি (তিরুচিরাপল্লী), হাযদ্রাবাদ, ভালো দাম পাবার তাগিদে। আমার এখানে প্রথম আসার দিন থেকে আজ পর্যন্ত প্রদীপের একটা স্বভাবে কোন হেরফের নেই। ওর কাছে এলেই ও আরোকিছুক্ষণ ধরে রাখতে চায়। আজ ওর আবদার - আমরা এসেই ফিরে যাচ্ছি, একটু কফি খেয়ে তারপর যাই। কিন্তু সাইক্লোন! সে তো এগিয়ে আসছে বেবাক তাড়ায়! সবাই ফিরছে আপন আপন আস্তানায়। আমরা আরো খানিকক্ষণ এখানে আটকে গেলে হোটেলে ফিরতে ফিরতেই সামুদ্রিক ঝঞ্ঝাবাত আমাদের ধরে ফেলবে মাঝরাস্তায়। প্রদীপ বলে সাইক্লোন তো আসবে মাঝরাতে এক কাপ কফিতে কি আর এমন হবে? আমরা দিনরাত এই সমুদ্রের সঙ্গে ঘর করছি। কিন্তু প্রদীপ, 1964 সালে এমনিই এক সাইক্লোনে তামিলনাড়ুর তট ছারখার হয়ে গেছিল। ধনুস্কোডির মত তীর্থস্থান এই ডাঙার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, এই দেশের থেকেই মুছে গেল প্রাচীন একটা শহরের পরম্পরা।

আর প্রদীপ আবহাওয়া দপ্তর বলেছে ঝঞ্ঝা মাঝরাতে আসবে মানে কি গুনেগেঁথে মাঝরাতেই আসবে? এখুনিও তো এসে যেতে পারে - দ্যাখো আকাশের অবস্থা। কিন্তু ততক্ষণে কফি এসে গেল।

কেন এমন করে প্রদীপ? এমন একটাজায়গায় যেখানে এসে ভুলে গেছি কোন কোন পথ ধরে এইজায়গায় এসে পৌঁছেছি। একদিকে উদ্বেল সমুদ্র ওপরে জলদগম্ভীর মেঘের তর্জনি। একটা কবিতার পংক্তি মনে পড়েগেল।

  • নীলঅঞ্জনঘনপুঞ্জছায়ায় সম্বৃত অম্বর

হে গম্ভীর! হে গম্ভীর!

না এটা এখানের কবিতা নয। এ কবিতায় মেঘের গাম্ভীর্য আছে কিন্তু সমুদ্রের চোখপাকানি নেই। আলোঅল্পতার, অনাগত তাণ্ডব শব্দদের ভযও নেই।

প্রদীপ , তুমি এই কবিতাটা পড়েছ?

না স্যার আমি অত শক্ত কবিতা পডি নি। আমি অতকিছু পড়াশুনা জানা ন ই। হাযার সেকেন্ডারি পাশ করলাম, সঙ্গে সঙ্গেই বিএসএফেরচাকরি।

প্রদীপকে ঐ মেঘসমুদ্রের কবলে রেখেই আমরা বেরিয়ে এলাম। এখন জানি কিসের টান। টানটা বাংলার।

রাস্তায় নামতেই চারদিক থেকে আমাদের চেপে ধরল তুমুল হাওয়া আর অন্ধকার করা বৃষ্টি।সেই অন্ধকারেই আছড়ে পড়ছে নানা আলোর বিদ্যুত্ ও কানফাটানো বাজ।বার বার ড্রাইভারের কাছ থেকে জানতে চাইছি ফিরতে পারব কি না। ড্রাইভার এমনিতে তো ইয়েস স্যার নো স্যার করে চালিয়ে দেয তার সঙ্গে দু একটা হিন্দী শব্দ জুড়ে। এখন সে ওয়াইপার ও কাচ পরিস্কার রাখার ব্যস্ততায় বিশুদ্ধ তামিল ছাড়া আর কিছু বলছে না। এত ঝডঝাপ্টা সামলেসুমলে এগোতে এগোতেই দূরে দেখতে পেলাম রামেশ্বরমের বিশাল মন্দির।কিন্তু হোটেলের কাছাকাছি পৌঁছাতেই বৃষ্টি ধরে গেল।

চলবে ...