বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ১৮, ২০২৪

ভারতবর্ষ,পর্ব ৬

ছয়

রিসেপশনের ছেলেটি আমাদের দেখে যেন একটু আশ্বস্ত হোল। আমরা ভিজিনি দেখে অবাক ও হোল সে। কি করে ভিজতাম ! গাড়ীতে বসেছি তখনো পর্যন্ত বৃষ্টি আরম্ভ হয়নি আর নামলাম যখন ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেছে।

আজ রাত্রে স্যার রুম থেকেও বেরোবেন না। বড়ো মাপের সাইক্লোন ধাক্কা দেবে মধ্যরাতের পর, আবহাওয়া দপ্তরের ওয়ার্নিং দেওয়া আছে।

হায় ! আমি তো ভাবলাম সাইক্লোন নেমেই গেছে। যেটা হোল সেটা কি ছিল তাহলে? এটা বলতে বলতেই দেখি দাপিয়ে বৃষ্টি নেমেছে আর উত্তাল হাওয়া চলছে, গাছেরা দুলছে সকল দিশায়। অল্পক্ষণের ভেতরেই বজ্রবিদ্যুত্ যোগ দিল বৃষ্টিপাতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে।ঐ ভাবেই কাটল খাওয়াদাওয়ার সময় পর্যন্ত। খেতে এসে দেখি খাবার জায়গাটা যেটা বিশাল একটা হল যেটির চারদিক খোলা - দুটো দিক আসা যাওয়ার জন্য দেখার কিছু না থাকলেও বাকী দুটো দিকই খোলে সমুদ্রের দৃশ্যে। এখন এক প্রবল হওযার দাপটে সব কিছুই অন্ধকারের কবলে। হোটেলে আলোর অভাব নেই। দেখছি সবকিছু এলোমেলো, তছনছ। বাইরে কোথাও কোন বাতির চিহ্ন নেই।

রাত্রেও এই তাণ্ডব চলল সারারাত। তার সঙ্গে নানা ধরণের শব্দ কিম্বা বলা যেতে পারে এক ই ধরণের নানান শব্দ যেখানে রাতের কুকুরবেডাল নেই। রাতপাখিরা নেই। শুধুই প্রপাতের শব্দ। কিছু পড়ে যাচ্ছে, কিছু ধ্বসে যাচ্ছে, পাল্লা খুলে যাওয়ার, পাল্লা সজোরে বন্ধ হয়ে যাওয়ার, হোটেল কর্মীদের ক্ষণিক হাঁকডাক। এদের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে একটা ঘুম ঘুম ভাব ।

রামেশ্বরম থেকে বেরিয়ে আমরা বড় শহর রামনাথপুরমকে বাইপাস করে একটা অতি নিকৃষ্ট রাস্তা ধরলাম। রাস্তাটা বৃষ্টিতে ডুবে আছে তার কিনারা দেখা যাচ্ছে না। খানাখন্দ ঢেকে থাকায় গাডীর গতি একেবারেই কমে এসেছে। কিন্তু অল্পক্ষণের ভেতরেই রাস্তাটা ভাল হযে উঠল। গাডীর গতি বাড়ল। আমরা হাইওয়েতে এলাম। বৃষ্টিপাতের বিরামহীন রাগালাপ ও খ্যাপামোর ক্রিয়াকলাপ চলছেই, ঝরঝর থেকে ঝমাঝম। বারিবর্ষণ থেকে বিদ্যুতবর্ষণ, আবহসংগীতে ক্কডাক্কড বাজ।এটাকেই বোধ হয় দুর্যোগ বলা হয় ।

তুতিকুড়ি পৌঁছুলাম দুপুর বারোটাও হয়নি। দুযার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া। খাওয়াদাওয়া দূর, একটা কাপ চা কফির জাযগা খোলা নেই কোথাও। তুতিকুড়ি একটা পুরনো বন্দর শহর। ইংরেজরা অত শক্ত নাম উচ্চারণকরতে পারত না বলে নাম রেখেছিল টুটিকরীন। সুপ্রাচীনএই বন্দর শহরটি অনেক এমন সাইক্লোনের সাক্ষী। এখানের মানুষ জানে সাইক্লোন হলে কি করতে হয। নতুন করে গডা হয়েছে টুটিকরীন পোর্ট তাতে বিশাল বিশাল জাহাজ দাঁড় করানোর ব্যবস্থা হারবারে। আমরা নির্বিঘ্নে শহর পেরিয়ে পোর্টএ এলাম। বিশাল বিশাল জেটি ফুটবল মাঠের মতো ভিজে থৈ থৈ হয়ে আছে। এখানে খবর নিলাম। সম্ভবত ভোর রাতে সাইক্লোন তটে আছড়াবে। বৃষ্টি, বজ্র, বিদ্যুত্ একটু থেমে জিরিযে নিচ্ছে। আমরাও একটুখানি বসে নিতাম কোথাও। এমনিই ফিরে যেতে হচ্ছে। আবার শহর পেরিয়ে যাওযা, এটা অন্যরাস্তা। এ রাস্তা দিয়ে আসি নি।বন্ধ দোকানপাটের বিষাদগাথা। শহর থেকে বেরোব বেরোব সময়ে হঠাত্ই রাস্তাটা সরু হয়ে এলো। একটা ছোটখাটো বাজার মতন জাযগা।, দুটো একটা লোক জমেছে দুপুরের খাবার সংগ্রহ করতে। একটা গুমটি মতন জায়গায় চা - কিমাশ্চর্যম, কফি নয় ।একটা দুটো দোকান খুলেছে তার একটা এই চেট্টিনাড হোটেল। আমরাও তো রেস্টুরেন্টকে হোটেলই বলে থাকি। তামিলনাড়ুতে এইসব হোটেলগুলোর অনেক ঘরাণা আছে। একটা উডুপি তারা নিরামিসাষী। চেট্টিনাডরা আমিষাষী।

দুপুরের খাওয়া সেরে আমরা কন্যাকুমারীর দিকে মুখ ফেরালাম। প্রথমে এলাম থিরুনেলভেললি, সেখান থেকে এক্সপ্রসওযে ধরে কন্যাকুমারী। তখনো দিনের অনেকটাই বাকী। সাইক্লোন আসে নি। এখনো থেমে থেমেই বজ্রবিদ্যুত্ বৃষ্টিচলছে। কণ্যাকুমারীও তটস্থ হযে আছে। যেদিকে যাই সেই দিকেই সমুদ্র হওয়াতে দিকভ্রম হযে যাচ্ছে। আমরা যে হোটেলে আছি তার দক্ষিন মুখে ভারত মহাসাগর। বিবেকানন্দ রকস পূর্ব উপকূলে।কণ্যাকুমারীর মন্দিরটি অতো বড়োসড়ো নয তটের বালিতে যেন ডুবে যাচ্ছে।মন্দিরের পরিসরও সঙ্কীর্ণ।ভেতরটা অন্ধকার। ইলেকট্রিক

বাতি জ্বলছে।যেন একটা গুহার ভেতরে ঢুকছি। কিন্তু এইসব মন্দিরের প্রাচীনত্ব আমাকে সব যুক্তি তর্কের বাইরে এনে চুপ করিয়ে দেয়।

বিবেকানন্দ রকস্ এখন বহিরাগতদের জন্য বন্ধ হয়ে আছে। এক চিলতে সমুদ্র পেরোতে হয় ফেরি নৌকোতে। সারাদিন ধরে ফেরি নৌকো পারাপার করতে থাকে বিবেকানন্দর স্মৃতিবিহারকে। ভেতরেও স্বামী বিবেকানন্দর এক বিশাল মূর্তি, ভারতবর্ষের দিকেতাকিয়ে থাকা। অথবা বলতে গেলে ভবিষ্যতের ভারতবর্ষের স্বপ্নে দৃষ্টি মেলে আছেন মহান দ্রষ্টা। এ ছাড়াও ওখানে আছে এক উপাসনাগৃহ। একটা পাথরের চট্টানের ওপর ছেনি হাতুড়ি দিয়ে খোদা হযেছে একটা সূর্য ঘড়ি। একটা সূর্যোদয়ের স্পটও চিহ্নিত করা আছে যেটা অতিথিদের কোন কাজে আসে না। অত সকালে এখানে পৌছুনর কোন সুবিধা নেই।

কন্যাকুমারী যখনই আসি সন্ধ্যা পেরিয়ো গেলে এই হোটেলের এই অলিন্দেই এসে বসি। ভারত মহাসাগর আমার মুখোমুখি। আর অন্ধকার। অত অন্ধকার আর কোথাও দেখি নি। তার গভীরতা আমার মনের সঙ্গে একটা সমতা গড়ে। অপার, এই শেষ নেই অন্ধকারের মুখোমুখি বসায় ভারত মহাসাগরের সঙ্গে একটা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সংবাদ নিহিত থাকে। অন্যবারে এখানেবসে অন্ধকারের ভেতরে আলোকণাদের খুঁজতে থাকি। একটা আলোকণা স্পষ্ট পেলে সঙ্গী আরোআলোদের দেখতে পাই আর পাই একটা পুরো জাহাজের আদল সেই আলোপুঞ্জকে ধরে ধরে। পুরো ব্যাপারটাই একটা খেলা যা আমার প্রবল মনোনিবেশ চায়। তখন গুনতে থাকি কুমারীকা অন্তরীপকে বেড় দিয়ে কটা জাহাজ পেরিয়ে যাচ্ছে কলম্বো বন্দরের দিকে।

আজ এখানে বসেই শুনতে পাচ্ছি ঢেউ এর আওযাজ। সমুদ্র প্রচণ্ড রকমের উত্তাল হয়ে আছে। এক একটা বিদ্যুত্ এর চমকানি চোখের ওপর খুলে দিচ্ছে আদিগন্ত ভারত মহাসাগর। ডানদিকে বাঁদিকে যে দিকেই তাকাই সমুদ্র। মাথায়ও কোন আকাশ নেই, নীরেট, ভাস্বর মেঘ ক্ষণে ক্ষণে জ্বলে উঠছে। প্রকৃতির এমন ভয়ঙ্কর রোষের চেহারা দেখা বিরল এক অভিজ্ঞতা। সামুদ্রিক ঝঞ্ঝাবাতের পূর্বাভাস এর চাইতে আরো ভালো করে দিতে পারত না কোন আবহাওয়া দপ্তর।সকালে বেরোলাম ঐ ঝড়ঝাপ্টা নিযেই। একটু বেলা করেই বেরিয়েছি। আমরা নাগরকযেল এর রাস্তা ধরে কোভলম বীচ যাবো। সেখানে রাত্রি বাস। পথে, রাস্তা থেকে একটু বেরিয়ে দেখে যাবো পদ্মনাভপুরম প্যালেস। এখনো সাইক্লোন তটে ঝাঁপিয়ে নামে নি। এবার তো আমরা পূর্ব উপকূল থেকেও বেরিয়ে এলাম। কোভলম পশ্চিম উপকূলে ।



চলবে ...