শনিবার, এপ্রিল ২০, ২০২৪

বাগড়ু থেকে বাটিক, শাড়িতে নারী

চিরশ্রী দেবনাথের, জন্ম 1979 এর 12 ফেব্রুয়ারি উত্তরপূর্ব ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের কৈলাসহর নামের একটি ছোট শহরে। বাবা রাধাগোবিন্দ মজুমদার সংস্কৃতের অধ্যাপক ছিলেন এবং মা মায়ারাণী মজুমদার। দুজনেই প্রয়াত। তিনি আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত শাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্হান অধিকার করেন। ছোটবেলা থেকেই লিখতে ভালবাসেন, ছোটগল্প, কবিতা, প্রবন্ধ ইত্যাদি। বিভিন্ন লিটিল ম্যাগাজিনে ও দৈনিক পত্রিকায় নিয়মিত লিখেন। পেয়েছেন ত্রিপুরা সরকারের অদ্বৈত মল্লবর্মণ ছোট গল্পপ্রথম পুরস্কার,

স্রোত সাহিত্য প্রকাশনার ছোটগল্প পুরস্কার, ত্রিপুরা সরকার তথ্য আয়োগ দপ্তর কর্তৃক আয়োজিত প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার। এখন পর্যন্ত সাতটি কবিতার বই এবং একটি গল্প সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। বইগুলোর নাম "জলবিকেলে মেঘের ছায়া ", "ঋতুক্ষরণের রোদচশমায় ", "প্রেমে সন্ত্রাসে ", "শুভ দ্বিপ্রহর ", "ঝাউবন ও জ্যামিতি বাক্স " , "উড়িয়ে দিও ", "বিশ্বাসের কাছে নতজানু " এবং কুুুুুড়িটি ছোটগল্প নিয়ে একটি গল্প সংকলন, "মায়ারাণী "।

পঞ্চাশটি অণুগল্প নিয়ে একটি ই বুক প্রকাশিত হয়েছে। আরোও দুটো বই প্রকাশিতব্য।কাজ চলছে। ২০১৯ এ, সুমিত্রা কর তরুণ লেখক সম্মান পেয়েছেন।তার লেখা, ছোটগল্প, "ব্যারনফিল্ড " অবলম্বনে তৈরি হয়েছে সর্ট ফিল্ম। তৈরি করেছেন কলকাতার রত্নদীপ রায়। যা নাইজেরিয়ার ইন শর্ট চলচিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছে। এছাড়া "কীর্ণকাল "নামে একটি লিটিল ম্যাগাজিন যৌথভাবে সম্পাদনা করছেন চারবছর ধরে। তিনি বিশ্বাস করেন কবিতা আত্মার সঙ্গে মিশে গেলে আর ফেরা যায় না।

শাড়ির কথা জিজ্ঞেস করতেই আগাগোড়া নারী চিরশ্রী ডুবে গেলেন ভারতের বহুবিচিত্র শাড়্রির রংমহলে । তুলে ধরলেন তাঁর বিপুল অভিজ্ঞতা ।


5f8b46fb37815.jpg

বাংলার তাঁত

সেলাইবিহীন এক অখন্ড বস্ত্রখন্ড, আজও মাতিয়ে রেখেছে সারা পৃথিবীকে, সম্ভবত ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীনতম পোশাক, যা রূপে, সৌন্দর্যে, জনপ্রিয়তায়, অভিযোজনে, পুরাতনে ফিরে যাওয়ায়, জীবনের প্রত্যেকটি উৎসবে, শোকে, আঁকড়ে ধরে আছে আমাদের সত্তাকে, সংস্কৃতে তার নাম শাটী, যার অর্থ পরিধেয় বস্ত্র।

গুপ্তযুগের আনুমানিক ( ৩০০ - ৫০০ ) খ্রীষ্টপূর্বে কালিদাসের কুমারসম্ভবে উল্লেখ আছে শাড়ির কথা, অজন্তা ইলোরার গুহাচিত্রেও রয়েছে শাড়ির ছবি যা বলে দেয় খ্রীষ্টাব্দ শুরুর সময়ে শাড়ি ছিল নারীর অঙ্গে, আবার পাহাড়পুর ময়নামতীর পোড়া মাটির ফলক থেকে বোঝা যায় হাজার বছর পূর্বে পূর্ববঙ্গেও ছিল শাড়ির প্রচলন।

আমাদের এই বিশাল দেশে, শাড়ির কত বাহার। অঞ্চলভেদে তার নক্সা, ইতিহাস, কাপড়ের বিভিন্নতা, পরার ধরন বদলেছে বার বার, রাজ্যে রাজ্যে শাড়ি আছে তার নিজস্ব আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে, মহার্ঘ শাড়ি থেকে শুরু করে গ্রাম বাংলার ডুরে শাড়ি, সাঁওতাল মেয়ের গায়ে জড়ানো তীব্র হলুদ লাল, কেরালার মেয়ের সমুদ্র ঢেউয়ের মতো সাদা সোনালী সুতীর শাড়ি কি অপরূপ বয়ান তার, এ বলে আমি সংগ্রাম এনেছি, ও বলে আমি সংসারে মেতেছি, সে বলে আমি মহুয়া পলাশের বসন্তের রাত্রি জয় করে এনেছি।

5f8b420a6b6f7.jpg

পিওর স্লিক প্রিন্টেট

সামান্য কয়েকটি নক্সার কাছ থেকে একটুখানি নির্যাস নিয়ে এই তেরোহাতের কাপড়কে হৃদয় দিয়ে ছুঁয়ে যাবো একটু, প্রথমেই বালি থইথই মরুভূমির প্রখরতায়, সেখান থেকে রঙ, শ্রম, ঘাম আর রক্তস্রোতের বুদবুদ নিয়ে গভীর ভারতে শাড়িভ্রমণে।

বাগড়ু

জয়পুর আজমীর সড়কের মধ্যে ছোট্ট একটি গ্রাম বাগড়ু। জয়পুর থেকে প্রায় ছত্রিশ কিলোমিটার দূর। যেতে পারেন বাইকে করে ধুলো উড়িয়ে সেই গ্রামের কাছে। চারশো বছরের প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে সে এখন বেঁচে থাকার লড়াই করছে। সেখানে কোন বিশাল প্রাসাদ বা দূর্গ নেই, নেই তেমন কোন সুস্বাদু খাবারের সন্ধান। আছে রঙ, কৃষ্ণমৃত্তিকা থেকে নিংড়ে বের করা হয়েছে তাকে, মাটির রঙে রঙীন হয়ে, আমাদের অঙ্গে তুলে দেয় একটি জায়গার বেঁচে থাকার সংগ্রাম, পরম্পরাকে টিকিয়ে রাখার অদম্য প্রয়াস। সঞ্জারিয়া নদীর জলসম্ভার আর তার রৌদ্রময় বালুকাভূমি ছিপা সম্প্রদায়কে আকৃষ্ট করেছিল এখানে বসত করার, পাশাপাশি ছিল রাজানুগ্রাহিতা। আজ জলের সংকট, নদী আর আগের মতো ভরা নেই, শুকিয়ে যাচ্ছে, আর তাই বেঁচে থাকার সংগ্রামও আরো কঠিন হচ্ছে।

5f8b343b48cd0.jpg

বাগডু ব্লক প্রিন্ট


১৯৭০ সালের হিপি আন্দোলন প্রায় টিমটিম করে চলতে থাকা ব্লক প্রিন্টিং এর এই গ্রামে একটি নতুন তরঙ্গ নিয়ে আসে, আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত হয় বাগড়ু ব্লক প্রিন্টিং। দেখতে সহজ সরল প্রিন্টিং এর মূল সুরকে বজায় রাখে তার ভেষজ সত্তা।

বাগড়ুর পাশ দিয়ে প্রবাহিতা সঞ্জারিয়া নদীর কাদামাটি, সোডা ও লাইমের জলে চুবিয়ে কাপড়গুলোকে প্রথমে বিশেষ মেটে রঙের আবহ দেওয়া হয়। তারপর কাঠের তৈরি ব্লক দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয় বছরের বছরের পর বছর চলতে আসা ফুল, পাতা নক্সার বাহার। প্রিন্টিং শেষে সমস্ত কাপড়ের ওপর ছড়িয়ে দেয়া হয় কাঠের গুঁড়ো, নাহলে রঙগুলো ধেবড়ে যাবার সম্ভবনা থাকে। এখন চাই গনগনে সূর্যের প্রখর তাপ। এই যে গ্রামটি, তার সামনেই রয়েছে প্রবেশতোড়ন, তোড়ন দিয়ে ঢুকলেই বাগড়ু শ্রমিকদের ঘর সংসার। বাড়ির উঠোনে, ছাদে, সর্বত্র মেলে দেওয়া আছে সার সার কাপড়। এখানে ওখানে রঙের চৌবাচ্চা।

5f8b3916ad2a6.jpg

কেউ তৈরি করছেন কাদামাটির মিশ্রণ, কেউ বা ভেষজ রঙ। এই রঙ বানানোকেই বলা হয় ডাবু।

প্রত্যেকটি পরিবারের বিশেষ কিছু ফর্মুলা থাকে নিজেদের রঙটির স্থায়িত্ব এবং সৌন্দর্যের জন্য। তবে কমন কিছু উপাদান তো রয়েছেই।

রঙ তৈরির একটি প্রধান উপকরণ হরিতকী। হরিতকীর সঙ্গে আঠা এবং এখানকার বিশেষ কৃষ্ণমৃত্তিকা, পচা আটা, লাইমস্টোন, গরুর গোবর মিশিয়ে রেখে দেওয়া হয়। সেটা থেকেই তৈরি হয় ফেব্রিক। ঘন নীলের দীপ্তিহীন আভিজাত্য।

ট্র্যাডিশনাল নক্সা থেকে বেরিয়ে এখন অবশ্য ফিউশনের সমারোহ। জেগে উঠছে তার মধ্যে অন্য অলঙ্করণ, তবুও মানুষ সেই সরলরৈখিক সৌন্দর্যকে পেতেই বাগড়ু শাড়িকে গায়ে জড়িয়ে প্রকাশ করতে চান চির চেনা এক

মরুজ্যোৎস্নাকে।

সাঙ্গানেরী

জয়পুরের কাছেই আর একটি গ্রাম সাঙ্গানের। পাঁচশো বছরের ব্লক প্রিন্টিংকে বাঁচিয়ে রেখেছে ছিপা সম্প্রদায়ের মানুষরাই। তাদের মূল বসত ছিল গুজরাটে। মোগল এবং মারাঠাদের ক্রমাগত লড়াই এ তারা চলে আসতে থাকে রাজস্থানের দিকে। এই ব্লক প্রিন্টিং এর সঙ্গে জড়িত প্রায় তিন হাজার মুসলিম পরিবার যাদের আদি বাড়ি ছিল পাঞ্জাবের সিন্ধু অববাহিকায়। সেখান থেকেই এইসব রঙমানুষেরা এসেছে উষর রাজস্থানের বুকে, মরুভূমির ধূসরতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে বানিয়েছে উজ্জ্বল রঙবেরঙের জ্যামিতিক ও ফুল পাতার নক্সাকাটা বস্ত্র, যা এখন বিশ্বনন্দিত, কাপড় ছিঁড়ে যাবে তবু কাপড় থেকে যাবে না রঙ এর গাঢ়ত্ব।

ব্লক প্রিন্টিং পদ্ধতি মোটামুটি একইরকম, অনেকগুলো ধাপ পেরিয়ে তবেই কাপড়ে আসে চিরাচরিত জেল্লা। খুবই গরীব এখানকার শাড়িশিল্পে জড়িত শ্রমিকরা, পরবর্তী প্রজন্ম আর আসছে না এই কাজে। ক্রেতাদের চাহিদার ওপর নির্ভর করে আসছে কনটেম্পোরারি ডিজাইন।

5f8b394aeffe8.jpg

সাঙ্গানেরী


স্ক্রিন প্রিন্টিং, রাসায়নিক রঙ, আধুনিক পদ্ধতি যা ছাড়া এখন আর উপায় নেই। দারিদ্র্যের ছাপ লাগানো কারখানা গুলো দেখলে বোঝাই যায় না আন্তর্জাতিক বাজারে চড়ামূল্যে বিক্রি হয় ভেষজ রঙে রাঙানো এসব ঐতিহ্যবাহী শাড়ি, আধুনিকার অঙ্গে জড়িয়ে জয় করে আসে অভিজাত মহল।

বন্ধুনী বা বাঁধনি

( tie the not) হ্যাঁ বাঁধনে বেঁধে রাখতে চাই। এই বস্ত্রকে বিবাহে মঙ্গলদায়ক বলে ভাবা হয়। প্রায় পাঁচহাজার বছর পুরনো বাঁধনি শাড়ির ইতিহাস।

বাণভট্টের হর্ষচরিতে সর্বপ্রথম বিবাহে এই শাড়ির ব্যবহারের উল্লেখ পাওয়া যায়। অজন্তার গুহাচিত্রের রঙীন চিত্রকলায় রয়েছে বাঁধনী বস্ত্রের ছবি। গুজরাটই এই শাড়ির জন্মস্থান আর স্বাভাবিকভাবে তা ছড়িয়ে পরে রাজস্থান বা পাঞ্জাবের কিছু কিছু অঞ্চলে। ক্ষেত্রী সম্প্রদায়ের লোকরাই পরম্পরাগত ভাবে বাঁধনী শিল্পকলাকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছেন।

5f8b3b5a6134c.jpg

বাঁধনি

হালকা রঙের কাপড়ের ওপর খোদাই করা ডিজাইন সিট পেতে রঙের প্রাথমিক ছোঁয়া দেওয়া হয়। তারপর সুতো দিয়ে বাঁধা। রঙে ডোবানো, শুকানো, চিরাচরিত পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যাওয়া। বাঁধনি শাড়ির মোহে, দোপাট্টার সৌন্দর্যে মন হারায়নি কোন্ বাঙালি তরুণী? যদিও বিষয় শাড়ি, তবুও বলি কুছ কুছ হোতা হ্যায় সিনেমার সেই দৃশ্য, যেখানে ট্রেনে করে অঞ্জলি বিদায় নিচ্ছেন, তার সাদা সালোয়ারের সঙ্গে লাল বাঁধনি ওড়না, উড়িয়ে দিয়েছেন হাওয়ায়,

পাগল করেছিল তখন কলেজ গার্লদের।

আজরাখ শাড়ি

এবার আমাদের যাত্রা, গুজরাটের কুচ (kutch) অঞ্চলের ছোট্ট গ্রাম আজরখপুরের দিকে। ভুজ শহর থেকে প্রায় পনের কিলোমিটার দূরে এই গ্রাম। জীবন্ত ইতিহাস হয়ে ধারন করে আছে এক শৈল্পিক সত্তার বহমানতা । সম্ভবত পৃথিবীর প্রাচীনতম একটি শিল্পকলা আজরখ ব্লক প্রিন্টিং , যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে বহু আগেই। অনেকের মতে আজরখ শব্দটির রয়েছে একটি আরবীয় অর্থ, যার মানে নীল, আবার কেউ মনে করেন । Ajj - rakh এর অর্থ হলো," keep it today ' ।

5f8b3d3bd98d6.jpg


আজরাখ শাড়ি

প্রায় চার হাজার বছর আগের মহেঞ্জোদারো হরপ্পার সেই রাজ পুরোহিতের বিখ্যাত মূর্তিটি যাকে আমরা ছবিতে দেখেছি বহুবার । কাঁধের পাশ দিয়ে এলিয়ে পরেছে একটি শাল। তাতে বিশেষ ফুলপাতার নক্সা। মনে করা হয় এটা এই আজরখ শিল্পকলারই নিদর্শন কিংবা আঠারোশ শতাব্দীর পুস্তক পাঠরত ক্ষেত্রী সম্প্রদায়ের একটি চিত্রকলা, সেখানে যে পোশাক পরা দেখা যাচ্ছে ব্যক্তিটিকে তাও আজরখ শিল্পসুষমায় তৈরি। এখন পর্যন্ত সমভাবে আদৃত, রাজস্থান এবং গুজরাটের কিছু অঞ্চল জুড়ে এই শিল্পকলা। চাহিদাও প্রচুর। সিন্ধু নদীর তীরেই এই প্রাচীন শিল্পকলার জন্ম এবং কিছু আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে পার্শ্ববর্তী জায়গাগুলোতে ছড়িয়ে পড়া। ক্ষেত্রী সম্প্রদায়ের মানুষরা যুগ যুগ ধরে ঘামে, রক্তে বাঁচিয়ে রেখেছেন একে। মোট চৌদ্দটি পদ্ধতি অবলম্বন করে তবেই পরিধেয় হিসেবে আমাদের অঙ্গে আসে আজরখ নন্দিত বস্ত্রসামগ্রী। যার মধ্যে রয়েছে কাপড়কে ধুতে ধুতে সম্পুর্ন নরম করে তোলা যা পরবর্তীতে ফেব্রিক করতে খুবই উপযোগী হয়, তারপর তার সাদারঙকে সরিয়ে দিতে এই অঞ্চলের বিশেষ কৃষ্ণমৃত্তিকায় কাপড়কে রাঙানো। তার রঙ বদলে দেওয়া। এর ওপর করা হয় ব্লক প্রিন্টিং। ভেষজ রঙ বানানোর প্রাচীন দক্ষতা রয়েছে পরিবারগুলোর। হরিতকী, চুন, আঠা, উটের বর্জ্যপদার্থ, নষ্ট লোহা ভেজানো জল ইত্যাদি বহু কিছু দিয়েই তৈরি হয় ফেব্রিক। ব্লক প্রিন্টিংএর ওপর কাঠের গুঁড়ো ছিটিয়ে শুকানো হয় কাপড়টিকে, নীল জলে ভিজিয়ে আবার কাপড়ের রঙ বদলানো, এসব পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যেতে যেতেই আমাদের হাতে আসে মরুভূমির ঘ্রাণ, অনুর্বর মাটির স্নেহ, প্রকৃতির দেওয়া ফলসম্ভারের সম্মেলনে সযত্নে রচিত অপরূপ দেশীয় বস্ত্র।

মধুবনী

মিথিলার জনকরাজার মেয়ে সীতার বিবাহ। জনকরাজা সেই বিবাহমণ্ডপ সাজাতে বললেন স্থানীয় কারিগরদের। প্রকৃতি থেকে তুলে আনা সামগ্রী দিয়ে রঙ তৈরি করে ফুল, লতাপাতা, জনসমাজে প্রচলিত বিভিন্ন অণুষ্ঠানের ছবি এঁকে অণুষ্ঠানমণ্ডপকে সুসজ্জিত করেছিল সেইসব প্রাচীন কারিগররা। এটাই মধুবনী পেইন্টিং এবং প্রিন্টিং এর আদিরূপ। বিহারের মধুবনী জেলা হলো এর প্রাণকেন্দ্র। মিথিলা, নেপাল এসব জায়গার শিল্প ও কৃষ্টির পরিচয় বহন করে মধুবনী পেইন্টিং। মূলত বেঙ্গল সিল্ক এবং মালবেরী সিল্কের আঁচলে আঁকা হয় রামায়ণ, মহাভারতের বিভিন্ন ঘটনা, আমাদের সামাজিক অণুষ্ঠান, ফুল, লতাপাতা, পশু, পাখি। কলমের নিব, দেশলাইয়ের কাঠি, সরু তুলি কিংবা খোদাই করা ব্লক বিভিন্ন মাধ্যমের সাহাযে এই চিত্রকলাকে প্রাণদান করেন দক্ষ শিল্পীরা। রঙ অবশ্যই ভেষজ।

5f8b3ea0bfc9c.jpg


মধুবনী

আমাদের সমাজ দেবনির্ভর, ধর্ম আর লোককথা আমাদের মজ্জায় মজ্জায়, পরিধেয় বস্ত্রকে সেই ভাবে সাজিয়ে আমরা ভারতীয় ঐতিহ্যের বাহক হতে চাই, আন্তর্জাতিক স্তরে সমাদৃত এই আর্ট বহমূল্য মধুবনী সিল্ক শাড়িকে তুলে দিচ্ছে আধুনিকাদের ওয়ার্ডড্রোবে। আর শিল্পীরা? তারা হাজার বছর ধরে একই পরম্পরাকে বজায় রাখার সাধনা করে যাচ্ছেন অভাবকে নিত্যসঙ্গী করে। গণ্ডকী, গঙ্গা আর মহানন্দা নদীর অববাহিকায়, হিমালয়ের পাদদেশে গড়ে ওঠা মধুবনী শাড়ি ভারতীয় শাড়ির সম্ভারে এক রত্নখচিত পালক।

বাঘ ( Bagh)

মধ্যপ্রদেশের ধর জেলার ছোট শহর বাঘ। চারশ থেকে ছয়শো শতাব্দীর বুদ্ধ ধর্মের অজস্র গুহা রয়েছে সেখানে।

ধীরে ধীরে অরণ্যাকীর্ণ হয়ে পরে গুহাগুলো, তখন বৌদ্ধধর্মের তেমন আর প্রসার নেই। এই গুহাগুলোতে একসময় বাসা বেঁধেছিল বাঘ। এ থেকেই জায়গাটির নাম হয় বাঘ। আস্তে আস্তে পুনরাবিস্কৃত হয় গুহাগুলো।

এই অঞ্চলের বিশেষ ব্লক প্রিন্টিংটির নামও তাই বাঘ। সূতী এবং সিল্ক দুধরনের কাপড়ের ওপরই ব্লক প্রিন্টিং করা হয়। ডিজাইন মূলত জ্যামিতিক, ফুল পাতা ইত্যাদি। ভেষজ রঙ ব্যবহার করা হয়। রুচিশীল, নরম, চিরাচরিত নক্সার এইসব শাড়ি ভারতীয় মিশ্রসংস্কৃতির অপরূপ সৌন্দর্যকে তুলে দেয় নারীর অঙ্গে।

কলমকারি

দক্ষিণ ভারতের বিজয়নগরে তখন তুলুভ বংশের রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের রাজত্বকাল। সাল ( ১৪৭০ - ১৫২১), এখন থেকে আনুমানিক পাঁচশ বছর আগে স্বর্ণমুখী নদীর তীরে গড়ে ওঠা জনবসতিতে ওনার পৃষ্ঠপোষকতাতেই কলমকারি শিল্পকলার বিস্তার। কলমকারির আর একটি জন্মস্থান হলো ইরান। কলমকারি শব্দটি দুটো পারসিক শব্দের মিলনে জন্ম। কলম এবং কারি ( মানে কারিগরী)।

কলমকারির জন্ম দক্ষিণ ভারতের দুটো জায়গায়। চেন্নাই থেকে ৮০ মাইল দূরে শ্রীকালহস্তী ও হায়দ্রাবাদ থেকে প্রায় দুশো মাইল দূরে মাসুলিপাটনাম।

5f8b419d28d81.jpg


কলমকারি শাড়ি

রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, পুরাণের কাহিনি নিয়ে তখন কথকরা ঘুরে বেড়াতেন, এইসব কাহিনিমালাই চিত্ররূপে প্রকৃতি থেকে খুঁজে নেওয়া রঙে সজ্জিত হয়ে উঠে আসে কলমকারি চিত্রকলায়। আর পারসিক প্রভাবে প্রভাবান্বিত মাসুলিপাটনামে কলমকারিতে আঁকা হয় ফুল ও পাতার নক্সা, মূলত ব্রিটিশদের খুশি করার একটি ইচ্ছা তখন কলমকারির কারিগরদের মধ্যে । কাপড়গুলো গরু এবং মোষের দুধে ভিজিয়ে শুকিয়ে নেওয়া হয়, তারপর কখনও তুলিতে এঁকে, কখনও ব্লক প্রিন্ট করে কলমকারি কাজ করা হয়। ভেষজ রং তৈরি এবং কাপড় গুলোকে পরিধানের যোগ্য করতে অনেক ধাপ রয়েছে। এক একটি শাড়ি নিঁখুত করে গড়ে তুলতে বহু ধৈর্য আর শ্রম দেন কলমকারি কারিগররা।

তাঞ্জোর এলাকায় মারাঠা রাজা সার্ফোজী এবং শিবাজীর রাজত্বকালে ব্রোকেডের ওপর আর এক ধরনের কলমকারি শিল্প সুষমা গড়ে ওঠে যার নাম কারুর্পুর শৈলী।

কলমকারির আন্তর্জাতিক খ্যাতি বহদিন আগে থেকেই। এই শাড়ি বিশ্বায়িত হয়েছে ভারতীয় ডিজাইনারদের ফ্যাশন ফিউশনে। কলমকারি শাড়ির সৌন্দর্য তার উজ্জ্বলতায় নয়, তার মেটফিনিসে, দীপ্তিহীনতার গাম্ভীর্যে, অজস্র কথকতা তাকে বর্ণন করে, সেই কথা আমাদের জন্ম থেকে শোনা, তাই কলমকারি পরা মানে ভারত আত্মার আসমুদ্রকে শরীরে জড়ানো।

বাটিক

যারা ইতিহাস পর্যালোচনা করেছেন, তারা জানিয়েছেন চারহাজার বছর আগে মিশরের মমি সংরক্ষণে মোমে চুবিয়ে তারপর শুকিয়ে তাতে বিভিন্ন নকশা করা একধরনের কাপড় ব্যবহার করা হতো, এটাই বাটিক প্রিন্টের আদিকথা। আর এই পদ্ধতিটিকে একটি ক্লাসিক শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যায় ইন্দোনেশিয়া, জাভা, বালি এইসব অঞ্চলের কারিগররা। সময়টি ছিল সপ্তম শতাব্দী। দিন বদলেছে, পদ্ধতির পরিবর্তন হয়েছে স্বাভাবিক ভাবেই।

5f8b4d2d92ad4.jpg

ধনেখালি

বাটিক শাড়ির সৌন্দর্য তার লালিত্যে, বঙ্গসুষমায়। শান্তিনিকেতনের দিগন্তবিস্তৃত মাঠ প্রান্তরে মরমী হয়ে উঠেছে মেয়েদের পায়ে পায়ে ছড়িয়ে পড়া বাটিকপাড়ের শৈল্পিক বাঙ্ময়তা। কোমল এই শাড়িটি গ্রীষ্মের দাবদাহকে স্বাগত জানায় উৎসবে যেতে হবে বলে , নৃত্যের আসর বসেছে তখন জ্যোৎস্না রাতে, দূরে কোথাও লাল মাটির মেঝেতে।

পুজো আসন্ন, আশ্বিনের মেঘে ছড়িয়ে যাচ্ছে নীল শিফন, সবুজ ধানের ক্ষেতে ধনেখালির টাটকা রঙ, ভরা নদীর ঢেউয়ে বালুচুরি শাড়ির ঠিকরে যাওয়া স্বর্ণাভ অহংকার, মফঃস্বলের রাস্তাটি এই সন্ধ্যায় নিজেকে ধুয়ে মুছে শরীরে জড়িয়েছে আটপৌরে দক্ষিণী সূতীর শাড়ি।

5f8b458424589.jpg

সম্বলপুরী কটন

আর আমি ভাবছি, পুজোয় মেয়েরা কি এবার শাড়ি পরবেন না ? অবশ্যই পরবেন। আমাদের এইসব নতুন শাড়ির মধ্যে বন্ধ কাপড়ের মিলের ভাঁজ করা আঁধার আছে, আছে আমার নিজস্ব অসহায়তা, আছে শুষ্ক আঙুলে দিনরাত কাজ করে যাওয়া খেটে খাওয়া মেয়েটির হাতে তৈরি ফ্যাশনেবল শাড়িটির সঠিক মূল্য দিতে না পারার ব্যর্থতা, আছে সেলফি তুলে ফেসবুকের পাতায় নিজেকে ঝরো পাতার মতো টানিয়ে দেয়ার কৃত্রিম তৃপ্তি । শাড়ির সঙ্গে অনাবিল এক আনন্দ জড়িয়ে থাকে মেয়েদের, শাড়িটি কেনার সময় ক্ষণিকের মোহ হয়, পরার সময় মনে হয় আচ্ছা কে কে দেখবে আমাকে? তারপর আয়নায় তাকাই, দেখি অনেক দূর চলে গেছে অরণ্যপথ, তাতে বুটিদার তাঁতের শাড়ি পরে হেঁটে যাচ্ছে মায়ের মতো কেউ।

ঝড় বাদলের দিনে ভিজে যাই যে শাড়ির কথা ভেবে, তা আর কিছু নয়, ক্লাস নাইনের স্কুলড্রেসের গৈরিকবরণ খয়েরী পাড়ের শক্ত করে কলপ দেওয়া সেই খসখসে শাড়িটি, তার মাধুর্য আজো খুঁজি এই চল্লিশের দিনে, শাড়িটি হারিয়ে গেছে আমার কুলুঙ্গির অতলে, তাকে আর পাবো না কোনদিন ।