বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৮, ২০২৪

বাংলা গানের সেকাল একাল – পর্ব ৮

স্বর্ণসময়ের প্রস্তুতি :রেডিওর দিন

বিশ শতকের একদম গোড়ায় গ্রামফোন রেকর্ডের প্রবর্তনের পর পরিশীলিত গায়নরুচি তৈরি হতে লেগেছিল আরো ১৫/২০ বছর । গ্রামফোন যুগের প্রথম দুটি দশকের কথা বলেছি আগেই । লালচাঁদ বড়াল, কে মল্লিক, ইন্দুবালা, কৃষ্ণচন্দ্র দে হয়ে বাংলা গান পৌছালো তিরিশের দশকে । চল্লিশ থেকে ষাটের দশক যে সময়কালটিকে বলি বাংলা গানের স্বর্ণযুগ তার, প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল এই তিরিশের দশকে ।

গত শতকের তিরিশের দশকে পৌঁছে বাংলা গানের আধুনিক হয়ে ওঠা বা বাংলা গানের স্বর্নযুগের সূচনা হওয়ার অনুঘটক হিসাবে চারটি ঐতিহাসিক ঘটনা কাজ করেছিল, সেগুলি হল (১) ১৯২৭এ রেডিও বা বেতার ব্যবস্থার সূচনা (২) ১৯২৮এ বাংলা গানের জগতে নজরুল ইসলামের আবির্ভাব, (৩) ১৯৩২এ বাংলা চলচ্চিত্রের সবাক হওয়া আর (৪) চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রগানের সফল প্রয়োগ শুরু হওয়া ।

গান বাঙালির প্রাণের জিনিস হয়ে ওঠায় বাংলা গানের চাহিদা বাড়লো, ১৯২৭এর ২৬শে অগস্ট কলকাতায় বেসরকারী উদ্যোগে বেতার সম্প্রচার শুরু হয়, করেছিল ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানী ।১লা এপ্রিল ১৯৩০ থেকে বেতার সম্প্রচার ব্যবস্থা সরকার নিজের হাতে নিয়ে নেয়, নাম হয় ‘স্টেট ব্রডকাস্টিং সার্ভিস’ । ৮ই জুন ১৯৩৬ থেকে সেই নাম পরিবর্তিত হয়ে হয় ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’,পরে আকাশবাণী। এখন রেডিওর যুগ প্রায় শেষ হয়েছে, রেডিও তার আভিজাত্য হারিয়েছে । কিন্তু একটা সময় ছিল যেদিন মধ্যবিত্ত মানুষের বিনোদনের যাবতীয় সম্ভার রেডিও নামক এই শ্রাব্য মাধ্যমে পরিবেশিত হত । গান মানুষের প্রাণের জিনিস হয়ে উঠেছিল আর গান শোনার সেরা মাধ্যম ছিল রেডিও ।

বাংলা গানের পথচলায় যেমন অসামান্য অবদান রয়েছে গ্রামফোন রেকর্ডের প্রবর্তন, তেমনই রয়েছে রেডিওর অবদান । রেডিও একদিকে গান শোনার সহজলভ্য সার্বজনীন মাধ্যম হয়ে উঠেছিল, অন্যদিকে তুলে এনেছিল অসংখ্য কন্ঠশিল্পী, গীতিকার ও সুরকার । বিশের দশক শেষ হবার আগেই বাংলার সঙ্গীতজগৎ পেয়েছিল পঙ্কজকুমার মল্লিক, শচিন দেববর্মন, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় প্রমুখকে আর তিরিশের দশকটা যেন বাংলার সঙ্গীত ক্ষেত্রে চাঁদের হাট । ১৯৩০ থেকে ৪০এর মধ্যে বাংলা গানের জগতে উঠে এলেন অনেক কালজয়ী কন্ঠশিল্পী, সুরকার ও গীতিকার । কুন্দনলাল সায়গল, কানন দেবী, আব্বাসউদ্দীন আহমেদ, যুথিকা রায়, কমলা ঝরিয়া, সুরসাগর হিমাংশু দত্ত, অনুপম ঘটক, গীতিকার মোহিনী চৌধুরী, শৈলেন রায়, জগন্ময় মিত্র, গৌরিকেদার ভট্টাচার্য, সত্য চৌধুরী, সুধীরলাল চক্রবর্তী, বেচু দত্ত, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, জ্ঞাণেন্দ্র প্রসাদ গোস্বামী, মৃণালকান্তি ঘোষ, অপরেশ লাহিড়ী, সুপ্রীতি ঘোষ, সুপ্রভা সরকার, দিপালী নাগ, তারাপদ চক্রবর্তী,কমল দাশগুপ্ত, সলিল চৌধুরী আরো কতজন, বাংলা গানের জগৎ যেন চাঁদের হাট । বাংলা গানের পথচলায় রেডিও বা বেতার ব্যবস্থার অসামান্য অবদান রয়েছে । সেই সময়ের গানের কথা বলতে গিয়ে বাংলা গানের দুই প্রবাদ পুরুষকে ছুয়ে যেতে হবে । তারা হলেন রাইচাঁদ বড়াল ও পঙ্কজকুমার মল্লিক, যারা বাংলা গানের স্বর্ণসময়ের প্রস্তুতির অন্যতম প্রধান কারিগর ।

রাইচাঁদ বড়াল

প্রখ্যাত ধ্রুপদ শিল্পী লালচাঁদ বড়ালের পুত্র রাইচাঁদ বড়াল যথার্থ অর্থেই ভারতীয় সঙ্গীত জগতের এক প্রবাদপুরুষ । তাঁর উত্তরসুরি সঙ্গীত পরিচালক অনিল বিশ্বাস তাঁকে অবিহিত করেছেন ‘ভারতের চলচ্চিত্রসঙ্গীতের ভীষ্ম পিতামহ’ নামে । জন্ম কলকাতায় ১৯০৩এ । ১৮২৭এর ২৬শে অগস্ট কলতায় বেতার ব্যবস্থার প্রবর্তনের প্রথম দিন থেকেই যুক্ত হন বেতারের সঙ্গে । রেডিওর সঙ্গীত বিভাগ ছিল তাঁর তত্বাবধানে । একমাস পরে তাঁর তত্বাবধানে রেডিওতে যোগ দেন ভারতীয় সঙ্গীতের আর এক লিজেন্ড পঙ্কজকুমার মল্লিক ।

রাইচাঁদ ১৯৩১এ যোগ দেন ভারতে চলচ্চিত্রের পথিকৃত নিউ থেয়েটার্স, তখন নির্বাক যুগ থেকে সিনেমা সবাক হওয়ার পথে, নেপথ্য সঙ্গীত ব্যবস্থা তখনো হয়নি, অভিনেতা-অভিনেত্রীরা গান গাইতেন সুটিং করার সময়েই লাইভ যন্ত্রানুষঙ্গ সহ । রাইচাঁদ বড়াল এদেশে চলচ্চিত্রে নেপথ্য সঙ্গীতের প্রয়োগ ঘটান ১৯৩৫এ নীতিন বসু পরিচালিত ‘ভাগ্যচক্র’ চলচ্চিত্রে বস্তুত, রাইচাঁদই বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম সঙ্গীত পরিচালক । চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রনাথের গানের প্রয়োগেও তিনি অন্যতম পথিকৃতের মর্যাদা পেয়ে থাকেন । সিনেমাসঙ্গীতের পিতৃপুরুষ রাইচাঁদ বড়ালের নির্দেশিত পথেই এদেশে সিনেমাসঙ্গীতের বিকাশ ঘটেছে । নিউ থিয়েটার্সের সঙ্গীতপ্রধান ছিবি চন্ডীদাস (১৯৩৪) ও বিদ্যাপতির (১৯৩৭) চূড়ান্ত সাফল্য তাঁকে খ্যাতির শিখরে পৌঁছে দেয় । দুটি ছবিরই হিন্দি সংস্করণ হওয়ায় সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে স্বীকৃতি পান রাইচাঁদ ।

বিদ্যাপতি চলচ্চিত্রের অভিনেত্রী কানন দেবী তার আত্মকথা ‘সবারে আমি অমি’ গ্রন্থে লিখেছেন “রাইবাবু সব সময় আমাদের কানের কাছে জপ করতেন, ফিল্মে গাইবার সময় গানটাকে শুধু গান বলে ভাবলেই চলবে না । প্রতি মুহুর্তেই মনে রাখতে হবে, গানটাও একটা সংলাপ; গল্পের অংশবিশেষ । ... তাঁর মতে গতানুগতিকভাবে অস্থায়ী,অন্তরা ইত্যাদি ক্রমপর্যায় ফিল্মসং-এ চলতে পারে না । নাটকের গতির সঙ্গে তাল রেখে গান আরম্ভ না হলে ছবিতে গান দেওয়ার কোনই মানে হয় না । ... রাইবাবুর অর্কেষ্ট্রা সম্বন্ধে প্রচুর অভিজ্ঞতা ছিল বলেই এতরকম সুরের আনাগোনার এমন হার্মোনাইজেশন সম্ভব হয়েছিল” । ১৯৫৩তে রাইচাঁদ মুম্বাই ফিল্মজগতে যোগ দেন এবং বহু হিন্দি ছায়াছবির সঙ্গীত রচনায় খ্যাতি পেয়েছিলেন । ১৯৭৮ সালে রাইচাঁদ বড়াল ভারতের চলচ্চিত্রশিল্পের সর্বোচ্চ সম্মাননা দাদাসাহেব ফালতে পরস্কার পান এবং ঐ বছরেই লাভ করের সঙ্গীত-নাটক আকাডেমি পুরস্কার তাঁর পচাত্তর বছর বয়সে । তিন বছর পরে ১৯৮১তে সঙ্গীতের ভুবন থেকে চিরবিদায় নেন বেতার ও চিনেমাসঙ্গীতের পিতৃপুরুষ রাইচাঁদ বড়াল ।

পঙ্কজকুমারমল্লিক:

বেতার কিংবা সিনেমাসঙ্গীতের আলোচনায় রাইচাঁদ বড়ালের সঙ্গে আর একটি নাম অবধারিতভাবে চলে আসে, তিনি পঙ্কজকুমার মল্লিক । বেতার ব্যবস্থারশুরুর দিন থেকেই জড়িয়ে ছিলেন রাইচাঁদ বড়াল আর পঙ্কজকুমার বেতারে যোগ দেন একমাস পরে । দুজনে যৌথভাবে অনেক চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন । তফাত এই যে রাইচাঁদ মুম্বাই চলে গিয়েছিলেন আর পঙ্কজকুমার মুম্বাইপাড়ি দেননি, কলকাতা বেতারের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন প্রায় অর্ধ শতাব্দী জুড়ে ।

ভারতীয় সংগীত ও চলচ্চিত্র জগতে যদি কাউকে যথার্থ অর্থে ‘লিজেন্ড’ বলতে হয় তবে নিশ্চিতভাবেই সেই নামটি পঙ্কজকুমার মল্লিক । ভারতীয় সংগীত এবং চলচ্চিত্র ও বেতার প্রচার শুরুর কাল থেকেই যুক্ত থেকে এই তিন শিল্পমাধ্যমকে সমৃদ্ধ করেছেন । বস্তুত, পঙ্কজকুমার মল্লিককে বাদ দিয়ে আমাদের বেতার ব্যবস্থা, চলচ্চিত্র ও আধুনিক কালের সংগীত জগতের ইতিহাস জানা যায় না সবটা ।

কম বয়সেই সংসারের দায় নিতে হয়েছিল । কোন ডিগ্রি নেই,সুতরাং চাকরীও নেই । পিতার নির্দেশে পাটের দালালির কাজে যোগ দিয়েছিলেন । কন্ঠে ছিল গান, তাই অনেকগুলি গানের টিউশানিও জুটে গিয়েছিল । ১৯২৭এর এক বর্ষামুখর সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় বৃষ্টি থেকে বাঁচতে আশ্রয় নিয়েছিলেন এক ডাক্তারবাবুর ডিসপেন্সারির রোয়াকে । সেখান দাঁড়িয়েই রবীন্দ্রনাথের গানের দুটো কলি গুনগুন করে গাইছিলেন – ‘এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়...’। ভেতর থেকে দক্ষিণ ভারতীয় ডাক্তার বাবু ডেকে নিলেন তাঁকে, বললেন ভেতরে এসে গানটা একটু শোনান তো, ভারি সুন্দর গাইছিলেন । সেই দক্ষিণ ভারতীয় ডাক্তারবাবুর নাম ডাঃ রামস্বামী আয়েঙ্গার । গান শোনার পর ডাঃ আয়েঙ্গার বাইশ বছরের সেই যুবকটিকে জিজ্ঞাসা করলেন তুমি কি রেডিওতে গান করতে চাও ? ওখানে আমার জানাশোনা আছে । যুবকটি হাতে চাঁদ পেলো,সম্মতি জানালেন । তখন সবেমাত্র এক মাস আগে বেসরকারী ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন গঠিত হয়ে বেতার সম্প্রচার শুরু করেছে । ১৯২৭এর ২৬শে সেপ্টেম্বর বাইশ বছরের সেই যুবক রেডিওতে গাইলেন রবীন্দ্রনাথের দুটি গান ‘এমন দিনে তারে বলা যায়’ ও ‘একদা তুমি প্রিয়ে’। তারপর সময়ের স্রোতে সেদিনের পাটের দালালি আর গানের টিউশানি করা সেই যুবক আপন সাধনা ও নিষ্ঠায় হয়ে গেলেন ভারতীয় সঙ্গীত জগতের প্রবাদপুরুষ পঙ্কজকুমার মল্লিক ।

১৯০৫ সালে উত্তর কলকাতার মাণিকতলায় পঙ্কজ কুমার মল্লিকের জন্ম। তাঁর পিতার নাম মণিমোহন মল্লিক ও মায়ের নাম মনোমোহিনী দেবী। সঙ্গীত শিক্ষাগুরু দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় । আত্মস্মৃতি 'আমার যুগ আমার গান' গ্রন্থে লিখেছেন 'পিতা-মাতা ও শিক্ষাগুরুর হাতে এবং সর্বোপরি কবিগুরুর কলমে উপ্ত একটা বীজ মন্ত্র ছিল তাঁর জীবনে। তা থেকে একটা প্রতিজ্ঞা গড়ে ওঠেছিল মনে, নিজের কথা ঘটা করে যেন কখনও না প্রচার করি। আমার পরিচয়টুকু কেবল রণিত হয়ে থাক আমার কণ্ঠে।'

বাংলা ও হিন্দি ছায়াছবির সঙ্গীত পরিচালনা ছাড়া অভিনয়ও করেছেন দু একটি ছায়াছবিতে কিন্তু বোম্বাইএর চিত্র জগতের ডাকে কোনদিন সাড়া দেন নি । রাজ কাপুরের মত নির্মাতার ডাকেও না । বাংলা ছায়াছবিতে নেপথ্য সঙ্গীতের প্রবর্তনা তিনি ও রাইচাদ বড়াল করেন । রবীন্দ্রনাথের অনুমোদন নিয়ে প্রথম কোন অবাঙ্গালি শিল্পীকে দিয়ে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাওয়ান ( কুন্দনলাল সায়গল) । প্রথম মহিলা শিল্পীকে দিয়ে সিনেমায় রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ানোর কৃতিত্বও পঙ্কজকুমারের (কানন দেবী ) । রবীন্দ্রনাথের স্নেহ পেয়েছিলেন,রবীন্দ্রনাথের গানের ভান্ডারী দীনেন্দ্রনাথ বা দীনুঠাকুরের কাছে গান শেখার সুযোগ পেয়েছিলেন পঙ্কজকুমার । রবীন্দ্রনাথের গানকে ঘরে ঘরে পৌছে দেওয়ার প্রথম দায়টা নিয়েছিলেন পঙ্কজকুমার আর তারপর সেই দায় কাঁধে তুলে নিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্ররা । চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রগানের প্রথম প্রয়োগ করেন পঙ্কজকুমারই । মুক্তি ছায়াছবির জন্য কাননদেবীকে রবীন্দ্রনাথের ‘আজ সবার রঙএ রঙ মেশাতে হবে’ গানটি শেখানোর সময় বলেছিলেন ‘তোমাকে এমন একখানি গান শেখাবো যা তোমার সারা জীবনের সম্পদ হয়ে থাকবে’ । কানন দেবী লিখেছেন “ পঙ্কজবাবুর গান শেখানোর ভঙ্গিটি ছিল বড় আকর্ষণীয় । সুর ও কথার ব্যঞ্জনা এমন সুন্দর করে বুঝিয়ে দিতেন যে মনের প্রতি পরতে যেন গাঁথা হয়ে থাকতো” । (‘সবারে আমি নমি’ / কানন দেবী)

সেই যে ডাক্তারবাবু রামস্বামী আয়েঙ্গারের হাত ধরে কলকাতা রেডিওতে গান গাইতে এলেন ১৯২৭এর ২৬শে সেপ্টেম্বর,তারপর রেডিওতেই থেকে গেলেন দীর্ঘ ৪৮ বছর । ১৯২৭এ পথচলার সূচনার পর দীর্ঘ কয়েক দশক কলকাতা বেতার মানেই ছিল বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র আর পঙ্কজ কুমার মল্লিক । ১৯২৯ থেকে প্রতি রবিবার সকাল নটায় ‘সঙ্গীত শিক্ষার আসর’ আর প্রতি বছর মহালয়ার প্রাতে ‘মহিসাসুর মর্দিনী’সঙ্গীত পরিচালনা ।

সেই প্রাণাধিক কলকাতা বেতার থেকে আঘাতও কম পাননি । ১৯৭৬এ বেতার কর্তারা নতুন রূপে প্রস্তুত করলেন মহালয়ার প্রাতঃকালীন অনুষ্ঠান । আঘাত পেলেন । তার একবছর আগে অবশ্য আরো বড় আঘাত পেয়েছিলেন রেডিওর সঙ্গীত শিক্ষার আসর তাঁরা বন্ধ করে দিলেন । ১৯৭৫এর সেপ্টেম্বরে রেডিও কর্তারা চিঠি দিয়ে জানালেন সঙ্গীত শিক্ষার আসর পরিচালনা থেকে তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হল । আত্মস্মৃতিতে পঙ্কজজ কুমার লিখেছেন ‘‘আসরে শেষ রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখিয়েছিলাম ‘তোমার শেষ গানেরই রেশ নিয়ে যাও চলে’। … তখন কি জানতাম এই গানই আমার আসরের শেষ গান হয়ে দাঁড়াবে! … মীরাবাঈ ভজন শেখাতে আরম্ভ করেছিলাম। এমন সময় অকস্মাৎ এক দিন আমার বাসভবনের ঠিকানায় এল এক চিঠি, পত্রলেখক কলকাতা বেতার কেন্দ্রের তদানীন্তন স্টেশন ডিরেক্টর। … অনুষ্ঠান প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হল। এক বোবা যন্ত্রণা আমাকে নির্বাক করে দিয়েছিল।… যে মীরাবাঈ ভজনটি শেখাতে আরম্ভ করেছিলাম সেটিকে, বলা বাহুল্য, শেষ হতে দেওয়া হল না।’’

কলকাতা বেতার থেকে পঙ্কজকুমারের অনাদর বিদায় শিল্পীমহলকে বিচলিত করেছিল । সূচিত্রা মিত্র লিখেছিলেন 'ওঁর তুলনা শুধু উনিই। ওঁর বিকল্প হয় না, ওঁকে বদলানো যায় না। ওঁর পায়ের কাছে বসে রবীন্দ্রসঙ্গীতের তালিম নিয়েছি। এই সঙ্গীত শিৰার আসরই আমার সঙ্গীত সাধনার প্রেরণা।' হেমন্ত মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন 'তাঁর মন রবীন্দ্রসঙ্গীতের দিকে ঝুঁকে ছিল পঙ্কজ মলিস্নকের গান শুনেই। সুধাকন্ঠ হেমন্তর দ্রোনাচার্য তো ছিলেন পঙ্কজকুমারই । রবীন্দ্রসঙ্গীত বিশেষজ্ঞ ও শিল্পী সন্তোষ সেনগুপ্ত রবীন্দ্রনাথের গান প্রচারের মূলে পঙ্কজ মল্লিককেকে তুলনা করেছেন শ্রীরামকৃষ্ণের বাণী প্রচারের ক্ষেত্রে স্বামী বিবেকানন্দের ভূমিকার সঙ্গে।

সঙ্গীত শিক্ষার আসরটি কেড়ে নেবার কয়েক মাস পরেই তাঁর ৪৪ বছর বয়সী অনুষ্ঠান 'মহিষাসুর মর্দিনী'ও কেড়ে নেওয়া হয়। এ আঘাতটি সইতে পারছিলেন না পঙ্কজ কুমার । পরদিন আক্রান্ত হলেন হৃদরোগে। চিকিৎসকের নির্দেশে থেমে যায় তাঁর গান গাওয়া । (সূত্র আনন্দবাজার পত্রিকা)

৯ই ফেব্রুয়ারি ১৯৭৮, তিয়াত্তর বছর বয়সে মৃত্যু হয় কিংবদন্তী সঙ্গীতসাধক পঙ্কজ কুমার মল্লিকের । মৃত্যর মাস খানেক আগে সম্পূর্ণ করেন আত্মস্মৃতি ‘আমার যুগ আমার গান, প্রকাশিত হয় ১৯৮০তে । ২০০৬এ ভারত সরকার তাঁর সন্মানার্থে প্রকাশ করে ডাক টিকিট । ১৯৭২এ পঙ্কজকুমার ‘দাদাসাহেব ফালকে’ সম্মাননায় ভূষিত হন ।

বাংলা গানের স্বর্ণ সময়ের প্রস্তুতি পর্ব এবং সেই প্রস্তুতি পর্বের দুই প্রবাদপ্রতীম সঙ্গীত ব্যক্তিত্বের কথা বললাম । বাংলা গানের আধুনিক হয়ে ওঠায় এবং তার স্বর্ণ সময়ের প্রস্তুতিতে বেতার ব্যবস্থার যেমন অবদান আছে তেমঅই অসামান্য অবদান আছে চলচ্চিত্রে সঙ্গীতের ।

আগামী পর্বে সেকথা বলবো ।


(আগামী পর্বে চলচ্চিত্রের সঙ্গীত)