সোমা সিনহা -- রাজধানী দিল্লির বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের সুপ্রতিষ্ঠিত অভিনেত্রী ও বাচিক শিল্পী । জন্ম কৃষ্ণনগর ,নদীয়া পশ্চিমবঙ্গ এবং বিবাহসূত্রে স্থায়ী ভাবে দিল্লীতে বসবাস ।কৃষ্ণনগর উইমেন্স কলেজ থেকে বাংলা সাহিত্যে শিক্ষালাভ ।অভিনয়ের পাশাপাশি বহু কালজয়ী বাংলা উপন্যাসের নাট্য রূপান্তর করেছেন । প্রকাশিত ইংরেজি গ্রন্থ ''. Encyclopedia of Fairs and Festivals in India. " দিল্লীর অগ্রণী নাট্যদল গুলির সঙ্গে বিযুক্তভাবে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন ।পরবর্তীকালে পুরস্কৃত ও সম্মানিত হয়েছেন। নিজস্ব নাট্যদল নবপল্লী নাট্যসংস্হার সাধারণ সম্পাদক।অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটক -- গোরা ,শেষের কবিতা ,ঘরে বাইরে ,পথের পাঁচালী ,মাইকেল মধুসূদন ,ভগিনী নিবেদিতা ,সুভাষের সহধর্মিণী ,নকশাল বাড়ি ইত্যাদি। এবং উৎকৃষ্ট অভিনয়ের জন্য ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেন ।
বৈদিক যুগে ভারতীয় নারীরা যথেষ্ট স্বাধীন ছিলেন । পরবর্তীকালে অসূর্যম্পশ্যা , অবরোধবাসিনী নারীর অবস্থান কি ছিল সে বিষয়ে আমরা অবগত হই যখন ইতিহাসের পাতা উল্টে খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে পৌঁছে যাই । দেশীয় সংকুচিতমূল্যবোধকে বাঁচিয়ে রাখতে সমাজের সব ক্ষেত্রে মেয়েদের প্রতি অন্যায় ,অবিচার ,অনাচার ,বৈষম্য রয়েই গেছে । কিন্তু বৃটিশ শাসনকালে বিদেশি ভাবধারায় প্রভাবিত হয়ে সমাজ সংস্কারক বা সংস্কার মুক্ত মানুষের দৌলতে মেয়েরা ক্রমশ অন্তপুর থেকে বেরিয়ে আসেন ।জ্যোতির্ময়ী দেবীর ভাষায় মানুষ নয় ,সমাজের যন্ত্র নারী জীবনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে।
রবীন্দ্রনাথ বললেন ----
'' নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার /
কেন নাহি দিবে অধিকার ,হে বিধাতা ''।
একসময় অন্দরমহলে দুর্ভেদ্য প্রাচীর ভেঙে নারীদের সমাজে অবাধে বিচরনের সাথেই আধুনিকতার জন্ম হল।। নারী মুক্তির স্বাদ পেল ।
আজ অতি আধুনিক যুগে নারীরা পূর্বের ন্যায় বাধা নিষেধের ঘেরা টোপে আবদ্ধ নেই ।আজ নিজেদের পছন্দসই পোশাক পরিচ্ছদ পরিধান করছেন । মিডি ,ম্যক্সি ,কুর্তা, ঘাগরা , জিনস্ ,সালোয়ার কামিজ ,কিম্বা শাড়ি ।
আমরা সবাই জানি শাড়ি পরার ঝকমারি অনেক, আর চাকুরীজীবি নারীরা শাড়িতে স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করতে পারেন না বলে শাড়ি পরেন কম । কিন্তু বঙ্গ নারীর প্রিয় পোশাক আজও শাড়িই । শুধু নারী কেন ,দেশী বিদেশী পুরুষদের শাড়ি শোভিতবঙ্গ নারীরা সমান আকৃষ্ট করে । আর বাঙালী নারী সে বালুচরী ,জামদানীই হোক কিংবা জরদৌসী ,কাঞ্জিভরম , তাদের যে শাড়িতেই দুর্বলতা তা স্পষ্ট প্রকাশ পায় । শুধু শাড়ির বৈচিত্রে নয় ,সূতি কিম্বা সিল্ক নয়, শাড়ি পরার ধরনে বাঙালী নারীরা অনন্য ।
বাংলার গ্রামে গঞ্জে ,মফস্বলে ,ছোট ছোট শহরে ,বিশেষ করে এখনো অন্দরে কিংবা বাইরে বঙ্গনারী শাড়িই পরেন ।
মনে প্রাণে তারা বিয়ে ,জন্মদিনে ,পূজো পার্বনে ও বিশেষ অনুষ্ঠানে শাড়িই পরেন । সে লাল শাড়িই হোক ,কালো কিম্বা নীল । উদাহরণ স্বরূপ কয়েকটি কবিতার ছত্র তুলে ধরি ---
''আচ্ছা কাল না হয় কালো শাড়িটাই পরে
এসো ।
হাতে পড়ো কাঁচের চুরি আর কপালে টিপ
কালো ,
আসতে যদি দেরীও হয়
রাগ না করে একটু ভালোবেসো ''।
আর একটি আধুনিক কবিতায় দেখি ---
''ওহে ,নীল শাড়ির মেয়ে ! নীলে তোমায় লাগছে --
অপরূপ ,নীলে নীলে নীলাভ তুমি যেন ঐ নীল --
আকাশের খন্ডরূপ ''।
শাড়ি যে বাঙালীর কত প্রিয় তার প্রমাণ আমরা চৌদ্দ শতকে পাই ।স্বয়ং চন্ডীদাস লিখেছেন ----
''নীল শাড়ি মোহন কারী ---
উছলিতে দেখি পাশ
কি আর পরানে সপিনু চরণে
দাস করি মনে আশ "।
বাঙালী তরুণীর জীবনে এক বিশেষ দিন তার বিবাহের দিনটি ।যখন সে শাঁখা পলা ,লাল টিপ ,সিঁদুর আর সেই সঙ্গে লাল বেনারসী সাজে লাজুক পা ফেলে শ্বশুর বাড়ির উদ্দ্যেশে পা বাড়ায় ।
মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান লিখেছেন ----
''পৃথিবীর সব রঙ আজ লাল
যখন লাল শাড়িতে তুমি
ভুবন ভুলানো মায়াবী সেই হাসি ।
সৌন্দর্যের উপমা তুমি
তোমার অদ্বিতীয় তুমি '' ।
দূর্গোৎসব হলো বাঙালীর হৃদস্পন্দন । বছরের সেরা উৎসব বলে কথা । আর বঙ্গনারী ,পূজোতে শাড়ি পরবেনা সেকি হয় ? সত্যি বঙ্গললনা যতই দেশী বিদেশী পোশাকে নিজের অঙ্গ ঢাকে ,শাড়ি না হলে তার শোভা কোথায় ?
এই পূজোর চারদিন সকাল আর সন্ধ্যেবেলার জন্য চাই ভিন্ন রকম শাড়ি ।
বাংলার শাড়ি ,যেমন টাঙ্গাইল ,ধনেখালী ,ফুলিয়া বা শান্তিপুরের তাঁত ,ঢাকাই মসলিন । পার্শ্ববর্তী উড়িষ্যার সম্বলপুরী কিম্বা উত্তর ভারতীয় ঝলমলে শাড়ি পূজোর কটি দিনে বঙ্গনারীর অঙ্গে শোভা পায় ।সূতি ,সিল্ক ,জর্জেট ,সিফন কিছুই বাদ যায়না ।
শুধু শাড়ি কিনলেই তো চলবে না।চাই ম্যাচিং ব্লাউজ পিস ।সেই ব্লাউজ পিস গুলিকে নিয়ে শরণাপন্ন হও ভালো দর্জির কাছে । ফ্যাশান দুরস্ত আধুনিক বঙ্গ নারী নানান কায়দায় ব্লাউজ তৈরি করে পূজোর কটি দিন সবাইকে চমক দিতে চান । শাড়ির সঙ্গে মানানসই গয়না সাজের একটা প্রধান অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায় ।
মোটের ওপর এই মহোৎসবে বঙ্গনারীর আরাধ্য পোশাক নানান রঙের চিরবরণ্য শাড়ি । এর বিকল্প নেই ।
প্রত্যক বছর এই পূজোর দিনগুলিতে শাড়ির রূপ আর পরার কায়দায় থাকে নতুনত্বের ছোঁয়া ।
তাই শাড়ি সে ম্যাজেন্টা ,সবুজ কিম্বা হলুদ শাড়িই হোক ,কোনো এক আধুনিক কবি ,ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে বাঙালী নারীর উদ্দেশ্যে বলেছেন ---
''শাড়ি সে তো শাড়ি ,দাম যেমন ই হোক
পরলে তারে লাগে ভালো ,যায় না ফেরানো চোখ ''।
সময়ের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে ,বেশ ভূষার পরিবর্তন সত্ত্বেও বঙ্গ নারীদের আমরা শাড়ি বিহীন কল্পনা ও করতে পারিনা ।
হোসনেয়ারা শাহেদ শাড়ি গ্রন্থে লিখেছেন --
শাড়ি প্রতীক ভালোবাসার ,প্রতিচ্ছবি নারীর , প্রতিকৃৎ সুরুচির ....শাড়ি প্রাচীন ও আধুনিকের সমন্বয় ।...বাংলার নারী ও শাড়িকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। পুজোর কটা দিনেতো নয়ই।