১মে সাংবাদিক, কবি নওশাদ জামিলের জন্মদিন। অন্যদেশ পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও শুভকামনা। নওশাদ জামিল আপনার আগামী হোক সাফল্যময়।
জন্মদিনে নওশাদ জামিলের একগুচ্ছ কবিতাঃ
উপপত্নী
তোমাকে দেখি না, দেখি ধোঁয়া ওঠা সুদূর প্রান্তর
মিশে আছে পথের গভীরে
ধূলিকণা তার খোলা পিঠ
পথের কিনার ক্ষীণ বাহু
ভাঙা সেতু, কালভার্ট যেন তার ঊরু
তোমাকে দেখি না, তা-ও নয়
সুরের ভেতর দিয়ে
ঘুমের ভেতর দিয়ে
দেখি, অপস্রিয়মাণ রেখা খেলা করে
তোমার দীঘল চুলে, মুখের আভায়
এখন তো ওই রেখা নেই
ধূলিওড়া দিন নেই
তবুও হঠাৎ উড়ে এল শালপাতা, অভিশাপ
বিকালের মরা রোদ নিয়ে খেয়াঘাট থেকে
ফিরে আসি দ্রুত পায়ে
পেছনে তখন মৃত, শীর্ণ বুড়িগঙ্গা
পড়ে আছে গভীর ছায়ায়
ছায়াগুলো বড় আনমনে
যখন-তখন উড়ে এসে জুড়ে বসে ছোট কাটরার ভাঙা জানালায়
উন্মাদিনী হেসে বলে, চম্পা বিবি মরে নাই
কে ছিলেন চম্পা বিবি, কেন এই সৌধ
বুঝতে পারি না কিছু
দেখি, অপস্রিয়মাণ একটা রেখা এসে
মুছে দেয় সমাধির অলৌকিক চোখের ইশারা।
ভূত অন্ধকার
(কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হককে)
বাবুই পাখির মতো ঝুলে আছি তালগাছে
মনে হয়, আমি আর এই দুনিয়ায় নেই
মাথার ওপর ঝাঁ ঝাঁ রোদ
নিচে শ্যাওলা ভরা পথ
হুশ করে উঠে, ঠুশ করে
নেমে যাচ্ছি বাড়ির উঠোনকোণে
হলুদ মাখানো ঝিঙে ফুলের মতন একটুও ভার নেই
হেলছি, দুলছি
ফিনফিনে আঁধার কোটর থেকে শুধুই ভাসিয়ে দিচ্ছি মিহি শ্বাস
জ্বর নয়, অন্য কিছু ঘিরে আছে নেশার মতন
দুপুরের ঘুঘু অযথাই শুরু করেছে বেদম ওড়াওড়ি
বুড়ি ছাই-রঙা মুরগিটা কক-কক করে
উড়ে গিয়ে পড়ল পেয়ারা গাছটার ডালে
চিচিঙে ফুলের মতো সাদা ডিম ফেটে বেরিয়েছে ছানা
আমায় একটি ছানা দেবে বলে
চেয়ে আছে পাতার আভায় ঢেকে যাচ্ছে লাজমুখ
বললাম, বিছানা পেতে দে
মাথাটা টাটাচ্ছে, চোখ ঝিলিক দিচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে
বিছানা পেতে দে, মরে যাচ্ছি এই বলে শুয়ে পড়লাম ভূত অন্ধকারে
সিলিং ফ্যানটা গড় গড় শব্দে ভরে দিচ্ছে ঘরময় সুখ
ভীষণ কাঁপছি, কাঁথা নয়
পশম-তুলার পেটে শুয়ে আছি গুটিশুটি মেরে
একটু পানি দে, মরে যাচ্ছি বলে
চেয়ে আছি মায়ের মতন মুখ তুলে কেউ একজন শিয়রে দাঁড়িয়ে
একটু পানি দে, মরে যাচ্ছি বলে চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে
চেয়ে আছি বোনের মতন মুখে তুলে কেউ একজন শিয়রে দাঁড়িয়ে
আমি তার হাত থেকে গ্লাস কেড়ে নিয়ে
বললাম, তোমার শরীরে ভূত ভূত গন্ধ কেন?
প্রেতাত্মাযুগল
দিনগুলো মনে হয় রঙচটা প্রাচীন প্রাসাদ
চুনকাম ঘষামাজা নেই বলে
গজিয়েছে শ্যাওলা
দুচারটি গাছ উঠে গেছে তরতর করে
জীর্ণ হতে হতে যদি ভেঙে পড়ে এই বাসনায়
ফিরে গেছে টিকটিকি
মাকড়সা গুটিয়েছে দেহ, উড়িয়েছে জাল
সবাই গিয়েছে চলে এই ভাবনায়
ইট-সুরকি, পোড়ামাটি খেয়ে লাল হল সূর্য
দিনগুলো বইতে বইতে সে-ও কুঁজো হবে জানি
সময় কি এত ভারি
হুড়মুড় শব্দ তুলে প্রশ্ন করে প্রেতাত্মাযুগল।
নিঝুম দ্বীপ
গহীনে দিয়েছ ডুব তাই ভেসে ওঠে
কালো দিঘি, মুখ তোলে ওই পদ্মফুল।
দূর থেকে দুটি চোখ তাকিয়ে এখন
মনে হয় পাতা ফেলবার সাধ্য নেই
মুখটি শুকনো এতটুকু, কতদিন
কতরাত উড়িয়ে পেরিয়ে উঁকি দিই
তোমাদের উত্তর-দুয়োরি ঘরটায়।
ভেতরে নিঝুম দ্বীপ, ছায়া ছায়া মুখ
ঠিক যেন আশ্বিন মাসের পেঁজা তুলো
বাহিরে নরম ক্ষীণ দুটি স্রোত, যেন
বালির ওপরে শুয়ে থাকা রাজহাঁস
ঢেউ আসে, ঢেউয়ের ওপর ঢেউ এসে
আছড়ে পড়ে ভেঙে পড়ে ঘরের পাঁজরে
ফুলদানি ডোবে, ভাসে শুধু ঝরা ফুল।
শৈশবযান
তেপান্তরে ওই দূরে ঝিকমিকে পাতার আড়ালে
লুকিয়ে রয়েছে রংতুলি, পেনসিল
কীভাবে ফিরব ধুলিমাখা পথে?
খালি পায়ে? মেঠো পথে ধরে
ধূ ধূ মাঠ, উঁচু-নিচু গাছগাছালির ঝোপ পেরিয়ে জোনাকপাড়া এসে
থেমেছে শৈশবযান
তখন ঘুমের ঘোরে অচেতন সারা গ্রাম
আশ্বিনের চাঁদ শুধু জেগে আছে চোখের ওপর
চারদিকে চিঁ চিঁ শব্দ, খচ খচ করা ছোট গর্ত
বড় গর্ত
হয়তো কেউটে বিচ্ছু বানিয়েছে ঘর
সরু গলি ধরে মিহি মিহি আলোকণা পাড়ি দিয়ে
কীভাবে পৌঁছাব?
গাছের ছায়ারা ঘিরে আছে পথে পথে
ছায়াগুলো বিষফলা
ধারালো বিজলি পেয়ে লুকিয়েছে গোপন কোটরে
জোছনাটা শাদা, রাত শাদা পথ শাদা
দূরের দিগন্ত শাদা
তবুও অক্ষরগুলো উড়ে উড়ে চলে মুঠো থেকে
হাতের আঙুলে মুছে ফেলি কালো কুচকুচে রেখাময় ছবি
কী আঁকব কী দেখব
পুঁতে রাখি বেলপাতা, সব হাহাকার
রাত বাড়ে, জোছনাটা তেজি হয়ে তেড়ে আসে চোখের মণিতে
চৌরাস্তার মোড়টাতে শেয়াল-বেজির জটলা পার হয়ে
গরম হাওয়ার স্রোত আসে
কাঁপে বাঁশপাতা
দোলে শালপাতা
পুকুরপাড়ের ঘন শিউলিগাছটা শির শির শব্দ করে
গাছ জেগে
রাত জেগে
চাঁদ জেগে
ঘুমে শুধু তল্লাটের শরীরী মানুষ
উঁচু ডাল নিচু ডাল সব শিরা-উপশিরাজুড়ে
শাকিনী ডাকিনী নাচে, পাতারা বেজায় খুশি হয়ে সুর ধরে
উঠে আয়, উঠে আয় গীত বাজে তেঁতুল গাছের মগডালে
মানুষ এখনও ঘুমে, জোছনাটা নিবে আসে ধীরে
কয়েকটি তারা
গোপনে তাকিয়ে আছে মুখ বরাবর
কী আঁকি কী খুঁজি ভেবে চেয়ে দেখে ইতিউতি
কয়েক পশলা উড়ো মেঘ
দুতিনটি বক
মাছরাঙা ঝাঁক বেঁধে উড়ে চলে বাঁশঝাড় থেকে।
কিছু প্রেম এসেছিল ভেসে
ঘাসের ডগায় শিশিরের কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে
রক্তফোঁটা ভোর
তখন জানালা খোলা, ঝিরঝির হাওয়া
হঠাৎ বাজিয়েছিল মন
তবুও সে আঁধার ভেবে উঠেছিল কেঁপে?
সুদূর পাহাড়তলে হয়তো লুকিয়ে ছিল
মনপবনের সুর, ভুল করে কেন যে বেসুরে
উঠেছিল বেজে?
প্রাণময়, অধীর বাসনা নিয়ে
কিছু প্রেম এসেছিল ভেসে, ভোরের বাতাসে।
কে তবে শিউরে উঠেছিল
ধ্বনিত হওয়ার এক ধরনের মোহ আছে জানি। আজ এই বুনো গন্ধমাখা পৃথিবীতে, এই হাওয়া এই সন্ধ্যা যেন এক একটা হাসির গোলক! কে তবে শিউরে উঠেছিল?
ঠিক সেই সন্ধ্যার মুহূর্তে ফিরে এসেছিল পথভাঙা বেপথু শ্রাবণ, এর সঙ্গে নিমিষেই উড়ে এসেছিল অচেনা পাখির গান। মুখে তার মুগ্ধ হাসি। সন্ধ্যার কুহেলী ছাড়া এইসব দৃশ্য বড় ম্রিয়মাণ। তার পরও কেন চেয়ে থাকি, ভাবি। জলের তলায় কলকল করে বেড়ে ওঠে অতৃপ্ত প্রহর। এ যেন কলমিলতার দীর্ঘ দীর্ঘ ছায়া। জল ছুঁয়ে মাটি ছুঁয়ে বলে, কান্ত হও।
তবুও এই দীর্ঘতর ছায়া মাড়িয়ে মাড়িয়ে চলে সারা পথ। অর্থহীন, অর্থহীন! আজ গতিসঞ্চারে কোনও প্রকার সম্মোহন নেই। জানি প্রতীক্ষার আছে বহু উৎস, বহু স্বর।