শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪

তিমির তীর্থ ভাগ-৭

প্রহ্লাদ অল্প থেমে রইল।

প্রভাত আরেকটা সিগারেট জ্বালিয়ে বলল,“দাঁড়াও,তুমি আমার সামনে কোনও স্বীকারোক্তি করতে এসছো না কি? খ্রিসচিয়ানরা মরার সময় সে কাজটা করে। তুমিও আমার কাছে কোনও স্বীকারোক্তি করে গিয়েই তেমন কোনও এক কাণ্ড করবার কথা ভাব নি তো?”

“তুমি সব কথা এমন হাল্কা করে ফেল কেন?” প্রহ্লাদ ক্লান্তিতে করুণ স্বরে বলল। তারপরে হঠাৎ যেন নতুন কোনও কথা একটা মনে পড়ে গেছে,সেরকম মুখ করে সে কথার সুর পালটে বলল,“অবশ্য তুমি নিজের অজান্তেই খুব সত্য কথাগুলো বলে ফেলেছ। আমি আসলে তোমার সামনে স্বীকারোক্তি একটা করতেই এসেছি।সঙ্গে এটিও সত্য যে তোমার সামনে স্বীকারোক্তি করবার পরে আমাকে হয়তো আত্মহত্যাও করতে হতে পারে।চমকে ওঠো না।আমি যে আত্মহত্যার কথা বলছি, সেটি আসলে মানসিক।”

প্রভাত হঠাৎ গম্ভীর হয়ে কিছুক্ষণ প্রহ্লাদের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল,তারপর কোমল শান্ত গলায় বলল,“বল! কী বলতে চাইছ,বল।”

প্রহ্লাদ কথা বলবার জন্য ঠোঁট মেলেও থেমে গেল।তার পুরো মুখে একটা লজ্জার আভা দেখা দিল।প্রভাত ঠিক বুঝতে পারল---প্রহ্লাদের মনের মধ্যে একটা ভীষণ অন্তর্দ্বন্দ্ব চলছে।সে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে রইল।কিছুক্ষণ প্রহ্লাদ নিজের সঙ্গে নিজে যুদ্ধ করে পরে বলল,“আচ্ছা প্রভাত,তোমাকে যদি হঠাৎ কেউ পনেরোশো টাকা মাইনের চাকরি একটা দিতে চায়,তুমি কী করবে?” কথাগুলো বলেই জীবনে প্রথম দেহ বিক্রি করতে তৈরি নিষ্পাপ কিশোরীর মতো প্রহ্লাদ লজ্জিত আর বিষণ্ণ হাসি মুখে নিয়ে এল।

প্রভাত তাকে চমকে দিয়ে হঠাতই খিলখিলিয়ে হেসে উঠল,“ও! কথা তবে এই! তোমাকে কেউ পনেরোশো টাকার চাকরি দিচ্ছে। সোজা না বলে আমার গায়ে খোঁচা দিয়ে বলছ কেন? কিন্তু ভাই,প্রশ্নটা আমাকে করে কী লাভ? আমাকে তো আর কেউ এমনটি যাচবে না।যাচলে এক মুহূর্তের জন্য আমার ভাবার দরকার পড়বে না। এক লাফে চাকরিটা কেড়ে নেব।”

“কেন” বুর্বকের মতো প্রহ্লাদ প্রশ্ন করল।

“কেন,মানে! কুকুরের মতো জীবনের আধা বয়স পার হল।খবরের কাগজের সাব-এডিটরি করে মাইনে পাই সাতশো টাকা।আজকের দুর্মূল্যের বাজারে সে টাকার ডালভাত খাবার কটাও জোটে না।অভাবের চিন্তায় আজ অব্দি বিয়েটাও করতে সাহস জোটাতে পারিনি।সে জায়গায় খেলার পুরস্কার পাবার মতো যদি হঠাৎ পনেরোশো টাকা পাবার মতো এই মাইনের চাকরি একটা পেয়ে যাই তবে সেটি কেন নিতে হবে সেই প্রশ্ন উঠতে পারে বুঝি?”

“কিন্তু... কিন্তু” বিশ্বাসের জোর না পাওয়া মানুষের মতো দুর্বল গলায় প্রহ্লাদ বলল,“টাকাই কি একমাত্র প্রশ্ন? তোমার টাকার বড় প্রয়োজন হতে পারে,কিন্তু তাই বলে অন্যায় কাজ করবার জন্য কেউ ঘুষ হিসেবে টাকা দিলেও তুমি নেবে কি? কেউ তোমাকে খুনের কাজে লাগাতে চেয়ে টাকা দিলেও কি নিয়ে নেবে? যে সত্য প্রকাশ করলে মানুষের মঙ্গল হয়---তেমন সত্য গোপন করবার জন্য উপহার দিলেও তুমি সে টাকা নেবে কি?”

“তুমি এই সব কি জট লাগিয়ে কথা বলছ,প্রহ্লাদ ? আগে বললে চাকরির কথা,এখন আবার বের করছ ঘুষের কথা। আমি তোমাকে এ সহজ সরল কথাটাই বলতে চাইছি যে বেশি মাইনের চাকরি পেলে আমি নিশ্চয়ই নেব।তোমারও নেয়া উচিত। টাকার জন্যই তো চাকরি করছি।তা হলে যে চাকরিতে বেশি টাকা পাবে সেই চাকরি নেবে না কেন?”

প্রভাতের নির্বোধ যুক্তি শুনে প্রহ্লাদ কিছুক্ষণ চুপ রইল। তার জীবনের এ জটিল সমস্যা বা মানসিক অন্তর্দ্বন্দ্ব নিয়ে আলোচনা করবার জন্য প্রভাত উপযুক্ত মানুষ কি না,সে নিয়ে তার মনে সন্দেহ উপস্থিত হল।কিছু সময় মনে মনে চিন্তা করে অবশেষে সে বলল,“তুমি একটা কথা ঠিকই বলেছ।কথাগুলো আমি সোজা-সাপটা না বলে বড় ঘুরিয়ে বলেছি।যে মানুষের বিবেক নির্মল নয়,যে মানুষ মনের মধ্যে গোপন অপরাধ বোধ লালন করে সেসব মানুষই সহজ সত্যের দিকে রাস্তা না নিয়ে এভাবেই নিজের সঙ্গে লুকোচুরি খেলে।আর যেতে দাও সেই সব কথা।সংক্ষেপে আমার সমস্যাটা এই যে একজন ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক নেতা নিজে যেচে এসে আমাকে একটা বড় চাকরি দিচ্ছে।যে সময় পাথরে মাথা কুটে মরলেও চাকরি পাওয়া যাচ্ছে না,তখন আমার মতো একটা মানুষকে কেউ যেচে চাকরি দিতে এলে তাঁর আসল মতলব সম্পর্কে সন্দেহ হওয়াই খুব স্বাভাবিক নয় কি? অবশ্য এক্ষেত্রে সন্দেহের অবকাশ নেই। জগন্নাথ চৌধুরীর আসল মতলব আকাশের দুপুর রোদের মত পরিষ্কার। কথাগুলো আমি তোমাকে ভেঙে বলছি।কথাগুলো আমি তোমাকে ভেঙে বলছি।ঘটনাচক্রে কিছুদিন আগে অসমে একজন অত্যন্ত ক্ষমতাশালী নেতা তথা মন্ত্রীর বিষয়ে তাঁর নিজের হাতে লেখা একটা কাগজ আমার হাতে পড়েছে।তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য একজন নেতা চুরি করে এনে কাগজটা আমাকে দিল।কাগজটাতে মন্ত্রীর বেনামী ব্যবসা সম্পত্তির পরিমাণ,কর ফাঁকি দেওয়া আদি অনেক বিপজ্জনক তথ্য লেখা আছে।কাগজটা কোনও ভাবে প্রকাশ পেলেই নেতাটির রাজনৈতিক মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী।কিন্তু আমার সম্পাদক সেসব তথ্য প্রকাশ করতে রাজি নন। তাঁর ধারণা যে সেই তথ্যগুলো প্রকাশ পেলে দীর্ঘ মানহানির মামলায় লুটোপুটি খাওয়া ছাড়াও তাঁর চাকরিটিও যাবে।অনেকদিন ধরে কাগজটি আমি বুকে বেঁধে ফিরছি।মন্ত্রীটি কথাটা জানতে পেরেছে।তিনি এও বুঝতে পেরেছেন যে কাগজটা আমার হাতে থাকা পর্যন্ত তাঁর শান্তি স্বস্তি আর নিরাপত্তা নেই।আমাদের সম্পাদক যে কোনও মুহূর্তে মত বদলাতে পারেন।আমি কাগজটা অন্য কোনও সাহসী সংবাদপত্রের সাংবাদিককে দিয়ে দিতে পারি।এমন কি বিরোধী পক্ষের কোনও এম পি বা এল এল এ-কে দিয়েও দিতে পারি।আমি আজ অব্দি কাগজটা আর কাউকে দিইনি এর জন্যেই যে তারা কাগজটি প্রকাশ না করে ব্ল্যাকমেইলের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।এখনও আশা রাখছি যে সময় হলে আমাদের কাগজেই তথ্যগুলো প্রকাশ করতে পারব।সে সম্ভাবনা রোধ করবার জন্য মন্ত্রীর দালাল জগন্নাথ চৌধুরীর দ্বারা আমার কাছে এই চাকরির অফার।এখন কথাটা বুঝলে?”

“কিছুই বুঝিনি।”প্রভাত চট করে উত্তর দিল,“ঘটনাটা শুনলাম।কিন্তু তোমার সমস্যাটা কী কিছুই বুঝিনি।তুমি শুরুতে এসেই আমার মনে এমন এক ধারণা সৃষ্টি করতে চেষ্টা করলে যে তোমার মনের মধ্যে কোনও একটা দ্বন্দ্ব চলছে।গোটা দুনিয়া জানে যে ড০অরবিন্দ বরুআ একজন জ্ঞান তপস্বী পণ্ডিত ইতিহাস চর্চার বাইরে আর কোনও ধান্দা নেই।কিন্তু তুমি জান যে তাঁর জীবনে পর্ণগ্রাফির জন্যেও স্থান রয়েছে।তেমনি পুরো অসম জানে যে প্রহ্লাদ হাজরিকা একজন সৎ,আদর্শবাদী বিবেকবান সাংবাদিক।আদর্শের জন্য সে স্বেচ্ছায় চরম দারিদ্র্য বরণ করে নিয়েছে।কোনও প্রলোভন তাকে টলাতে পারে না।কিন্তু এখন কি তুমি এটিই বলতে চাইছ না যে বাইরে তোমাকে যেমন দেখায় তুমি আসলে তেমন মানুষই নও?মনের মধ্যে তুমিও লালন করছ গোপন লোভ আর উচ্চাকাঙ্ক্ষা?সোজা ভাষায় বলতে গেলে এই পনেরোশো টাকার চাকরির প্রতি তোমার মনে প্রচণ্ড লোভ জন্মেছে।শুধু চক্ষু লজ্জার জন্যেই এটি নিতে পারছ না?মোট কথা তোমার সমস্যাটা হচ্ছে,to take or not to take। একেবারে হেমলেটিয় নৈতিক সংকট!”

প্রভাতের শেষ কথা কটিতে এমন এক শাণিত বিদ্রূপের সুর ফুটে উঠল যে প্রহ্লাদে হৃদপিণ্ডে একটি শেল যেনএ ফোঁড় ও ফোঁড় করে চলে গেল।হঠাৎ এক প্রকাণ্ড শারীরিক আর মানসিক দুর্বলতা তাকে চেপে ধরল।চেয়ারটার থেকে উঠে গিয়ে সে প্রভাতের বিছানায় গিয়ে গড়িয়ে পড়ল।চোখ দুটো মুদে অনেকক্ষণ স্থির হয়ে পড়ে রইল।সে মনে কষ্ট পেয়েছে বলে বুঝতে পেরে প্রভাত লঘু পরিহাসের সুরে কথা দুই একটা বলতে শুরু করল।কিন্তু কোনও কথাই প্রহ্লাদের কানে গেল না।এটা ওটা নানা কথা বলেও প্রভাত যখন প্রহ্লাদের মুখে কথা বের করতে পারল না তখন ধৈর্যচ্যুত হয়ে প্রায় চেঁচিয়ে বলল,“দেখ প্রহ্লাদ, তুমি আমাকে যতটা গাধা বলে মনে কর,আমি তত গাধা নই। বুঝলে?তোমার মনে আসলে কীসের দ্বন্দ্ব চলছে সে আমি বুঝিনি মনে করেছ কি?আমি সবই বুঝতে পেরেছি।শুধু তোমাকে আঘাত দেবার জন্যে ইচ্ছে করেই এভাবে বলেছি।মানুষের মাঝে মাঝে আঘাত পাওয়াটা খুবই ভালো।কেবল ভালোই নয়,মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য সে অতি দরকারিও।শোন,আসলে তোমার মনে কোনও লোভ নেই।এখনও কোনও লোভের উদয় হয় নি।কিন্তু তোমার মনে এক প্রচণ্ড অভিমান পুঞ্জিভূত হয়েছে।আমি জানি, তুমি জীবনে এক আদর্শ মেনে চলতে গিয়ে অনেক ত্যাগ করেছ।বহু প্রলোভন জয় করেছ।স্বেচ্ছায় চরম কৃচ্ছ্র সাধনের পথ বেছে নিয়েছ।কিন্তু তোমার মনে এটাই অভিমান যে সমাজ তোমার এই দুঃখ ব্রতের কোনও স্বীকৃতি দেয় নি।বরং মানুষ নানা মিথ্যা কুৎসা রটনা দিয়ে তোমার জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে।কত মানুষ তোমার বিরুদ্ধে কত মিথ্যে বদনাম করে ফিরে।কেউবা বলে তুমি সি আই এ-র এজেন্ট।কেউ বা বলে শাসকদলের সঙ্গে তোমার গোপন মিতালি আছে।আর এর সুযোগ নিয়ে তুমি অনেক সা-সম্পত্তি করে নিচ্ছ।কেউ বা বলে,তুমি মন্ত্রীর দালাল।তোমার অনেক বেনামী ব্যবসা আছে।এসব কথা আমার কানে পড়েনি বলে ভেবো না।এ কথাও সত্য যে অনেক মানুষ এসব কথা বিশ্বাস করে।মানুষকে দোষ দিয়ে লাভ নেই।গোটা সমাজটাই এমন হয়ে পড়েছে যে সততাকে জীবনের এক স্বাভাবিক কথা বলে ভাবতে মানুষ ভুলে গেছে।সে এমন এক বিরল ব্যতিক্রম যে মানুষ শেয়ালের শিং আছে বলে বিশ্বাস করলেও কারও বা সততা আছে বললে সহজে বিশ্বাস করতে চায় না।চারদিকের ঈর্ষা,সন্দেহ আর ঘৃণার শরাঘাতে জর্জরিত হয়ে তোমার মনে হঠাতই এক বড় দুর্বলতা এসেছে।তুমি হয়তো ভাবতে শুরু করেছ---সব রকমে সৎ হয়ে থেকেও যদি তুমি মানুষের চোখে মতলববাজ,স্বার্থপর আর ভণ্ড হয়েই থাকলে তবে আর এই কৃচ্ছ্রসাধনের মূল্যই বা কী? অর্থই বা কী?এমন করে থেকে তুমি একুল ওকুল দুকুল হারিয়েছ।ঘরে তোমার ছেলেমেয়ে দুবেলা দুমুঠো পেট ভরে খেতে পায় না।অথচ লোকে ভাবে তুমি প্রস্টিট্যুশন অর্থাৎ সাংবাদিকতার বেশ্যাবৃত্তি করে টাকার পাহাড় বানিয়েছ।সুতরাং এই মূল্যহীন কৃচ্ছ্রসাধন করে নিজেকে আর ছেলেমেয়েকে সব দিক দিয়ে বঞ্চিত করার থেকে না চাইতে এসে পড়া পনেরো শো টাকার চাকরিটা নিয়ে অন্তত একটা কুল রক্ষা করে চলাই বেশি ভালো।এটুকুই তোমার মনের ভাব নয় কি? সত্যি করে বল!”

প্রহ্লাদ চোখ দুটো মেলে কিছুক্ষণ প্রভাতের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।তাকে অত্যন্ত ক্লান্ত আর বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল।কী একটা বলতে চেয়েও কথা বলতে যেন সে শরীরের জোর খুঁজে পাচ্ছিল না।কিছু সময় তেমনি নীরব হয়ে থেকে অবশেষে সে বলল,“আচ্ছা প্রভাত,আমি মেনে নিয়েছি তুমি অনেক পরিমাণে আমার মনের ভাব ধরতে পেরেছ।তর্কের খাতিরে এটাও ধরে নাও—এটাই আমার প্রধান সমস্যা,একমাত্র সমস্যা।অনেস্টলি একটা কথা বল তো---আমার অবস্থায় পড়লে তুমি নিজে কী করতে?সব অহংকার বিসর্জন দিয়ে তুমি এ চাকরিটা নিতে কি না মনের মধ্যে গোপন লোভ,ক্ষোভ আর অভিমান দমন করে রেখে নিষ্ফল আত্মক্ষয়ী দারিদ্র্যের মধ্যে জীবনটা শেষ করতে?”

প্রভাতের মুখের স্বাভাবিক চপলতাটুকু হঠাৎ মিলিয়ে গেল। গম্ভীর হয়ে সে বলল,“আমাদের এই গম্ভীর আলোচনার বিষয়বস্তুটা কী প্রহ্লাদ?কোনও কুচক্রী রাজনৈতিক নেতা অসমের একজন সৎ আদর্শবাদী সাংবাদিককে পথভ্রষ্ট করবার জন্য উপহার হিসেবে এক লোভনীয় চাকরি এগিয়ে দিচ্ছে।চাকরিটা সে নেবে,না নেবে না---সেটাই তার সামনে বড় প্রশ্ন।কিন্তু প্রহ্লাদ,আমি নির্মমভাবে তোমাকে একটা কথা বলি—তুমি রাগ কর না।সামান্য চাকরি একটার প্রস্তাব পেয়েই যে মানুষের মনে দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয়,লোভের উদয় হয়, কর্তব্যাকর্তব্যের উভয় সংকট সৃষ্টি হয়--- তেমন মানুষকে সৎ আর আদর্শবাদী বলতে পারি কি? আমি যদি বলি যে তোমার মনে সারাক্ষণ লোভ ছিল,ছিল না শুধু সুযোগ---সেই জন্যেই তুমি এতদিন সততা আর আদর্শের মুখোস একটা পরে মানুষকে ফাঁকি দিয়ে ঘোরাফেরা করতে পারছিলে।কিন্তু প্রথম সুযোগের গন্ধ পাওয়া মাত্রই তুমি মুখোস খুলে নিজের আসল রূপে বেরিয়ে এসছ।তবে এর উত্তরে তুমি কী বলবে?অবশ্যই এই কথাও ঠিক যে পৃথিবীতে বীর আর অসম সাহসী বলে পরিচিত অনেক মানুষ প্রকৃতপক্ষে ছিল নৈতিক আর শারীরিকভাবে কাপুরুষ।কাপুরুষতাকে গোপন করবার জন্যই তাদের অতিমাত্রায় বীরত্ব দেখাতে হয়েছিল।তোমার ক্ষেত্রেও যদি ঠিক তাইই হয়েছে,তবে সে কথা আমি জানিনে।যেহেতু মনে মনে তুমি খুব লোভী,সেই জন্যেই বাইরে তুমি খুব বেশি পরিমাণে নির্লোভ আর ত্যাগীর ভূমিকাতে অভিনয় করতে হয়েছে।”

প্রহ্লাদ কিছু একটা বলবে বলে প্রভাত অপেক্ষা করে রইল।কিন্তু প্রহ্লাদ কোনও কিছু না বলে এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল।দুজনে কিছুক্ষণ নীরব হয়ে রইল।হঠাৎ একবার নীরবতা ভেঙে প্রহ্লাদ করুণ একটা হাসি হেসে বলল,“প্রভাত,তুমি একটা কথা জান যে গ্রামে আমার অনেক পৈত্রিক সম্পত্তি আর ছোটোখাটো একটা জমিদারি ছিল? আজকের বাজারে কম করে হলেও তার মূল্য লাখ টাকা হত।কিন্তু আমি সেই কবেই সে জমিজমা আমাদের আধিয়ারদের দান করে দিয়েছি।তবুও আমি এক বোর্জুয়ার দালাল।অন্যদিকে আমাদের বিখ্যাত কম্যুনিস্ট নেতা ত্রিনয়ন কাকতি গ্রামে একটা জমিদারি রেখে আর শহরে দুটো করে পাকাঘর বানিয়েও সমাজে বিপ্লবী আর সর্বহারার বন্ধু বলে পরিচিত।আর একজন কম্যুনিস্ট নেতা দিগম্বর শহরীয়ার কথা বলি শোনো।সম্প্রতি তিনি নতুন ঘর একটা করে গৃহপ্রবেশ উৎসবে আমাদেরও নিমন্ত্রণ করেছিলেন।গিয়ে দেখি ঘরে তাঁর সত্যনারায়ণ পুজোর বিশাল আয়োজন।তাঁর স্ত্রীও কম্যুনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্যা।একদিন ললিতা রাস্তায় তাঁর দেখা পেল। শহরীয়া দেবীর কপালে এক বিশাল সিঁদুরের ফোঁটা।গলায় এক নার্জি ফুলের মালা আর হাতে একটা টোপলা নিয়ে রিক্সায় করে ঘরে যাচ্ছেন।তাঁর মূর্তি দেখে কৌতূহলী হয়ে ললিতা জিজ্ঞেস করল,“মালা টালা পরে কোত্থেকে এলেন?” কম্যুনিস্ট নেত্রী অম্বা শহরীয়া অম্লান বদনে জবাব দিলেন,“আর বলবেন না, বুঝলেন কি না! গেলবার দিগম্বর নির্বাচনে দাঁড়ালে কামাখ্যাতে মানত করেছিলাম! আজ তাই দিয়ে এলাম।”

প্রহ্লাদ অল্প চুপ করে রইল। প্রভাত জিজ্ঞেস করল, “তোমার সমস্যাটার সঙ্গে এসব কথার সম্পর্ক কী?”

প্রহ্লাদ কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না।কোনও এক অনুশোচনার গ্লানি মুহূর্তের মধ্যে তার মুখ আঁধার করে ফেলল।নিজেরই কথার প্রতিবাদ করবার মতো মাথা ঝাঁকড়ে ঝাঁকড়ে সে সম্পূর্ণ অন্য সুরে বলল,“আমি বড় ভুল করেছি প্রভাত। এসব কথা বলে আমি ভীষণ বড় ভুল করেছি।কী অধিকার আছে আমার...।”

প্রভাত খুবই অবাক হয়ে বলল,“আরে হঠাৎ কী হল তোমার? কী ভুল হবার কথা বলছ?”

“এতক্ষণ ধরে বলছি কী তোমাকে?”প্রহ্লাদ বলল,“বলছিলাম,মানুষের নিন্দা আর সমালোচনার বিষাক্ত তীর আমাকে কী করে জর্জরিত করছে--- সেসব কথা।কিন্তু এখন নিজে কী করছি?ত্রিনয়ন কাকতি আর দিগম্বর শহরীয়ার নিন্দাতে পঞ্চমুখ হয়ে উঠেছি।আমি খুব ভালো করেই জানি প্রভাত,অন্তত আমার সে অধিকার নেই। Judge not,that ye be not judged---মানুষ একজনের বাইরেরটা দেখে আমরা তার সম্বন্ধে কদ্দূরই বা জানি?ত্রিনয়ন কাকতি বা দিগম্বর শহরীয়ার আজকের আদর্শচ্যুত আর ভোগ সর্বস্ব জীবন যদ্দূর সত্য,ঠিক তদ্দূরই সত্য তাঁদের অতীতের ত্যাগ,আদর্শের জন্য অপরিসীম দুঃখ স্বীকার।তাঁদের সমালোচনা করবার অধিকার কারও নিশ্চয়ই আছে।কিন্তু সেই ব্যক্তি কখনও আমি নই।তুমি জান প্রভাত,আমরা সবাই—আমি, ত্রিনয়ন কাকতি, দিগম্বর শহরীয়া---আমরা সবাই প্রায় একই সময়ে একই সঙ্গে বিপ্লবী জীবন আরম্ভ করেছিলাম। আমি নিশ্চিতভাবে জানি যে যে গভীর আদর্শনিষ্ঠা আর আবেগের সঙ্গে আমরা সেই দুর্গম পথে পা দিয়েছিলাম---সেই আদর্শনিষ্ঠা আর আবেগে বিন্দুমাত্র ফাঁকি ছিল না। জীবনে একটা সময় এসেছিল—যে সময়ে আমরা সবাই হেসে হেসে ফাঁসিকাঠে চড়তে পারতাম। কিন্তু সেই সময় কখন কী করে পেরিয়ে গেল আমরা কেউ বলতেই পারলাম না।মাঝে মাঝে আমার মনে হয়---যৌবন কালটা জীবনের শ্রেষ্ঠতম সময় এ জন্য নয় যে, সে সময়েই ভোগের শক্তিও অপরিমেয় হয়।যৌবন জীবনের শ্রেষ্ঠ ঋতু এ জন্য যে সে সময় অপরিমেয় প্রাণ প্রাচুর্যের বলে মানুষ অতি অকৃপণ হতে পারে।জীবনকে বেপরোয়া ভাবে খরচ করতে পারে।মৃত্যুর চোখে চোখ রেখে মানুষ বলতে পারে যে মৃত্যুর চেয়ে জীবন বেশি মহৎ আর বলশালী।আজ আমরা যার জন্য হাহাকার করে মরি সে আমাদের হারানো যৌবন।আমাদের হারানো স্বপ্ন আর আদর্শ।... ত্রিনয়ন কাকতি বা দিগম্বর শহরীয়াকে সমালোচনা করবার কোনও অধিকার আমার নেই প্রভাত।আমরা প্রত্যেকে সমান ক্লান্ত,পরাজিত আর নতজানু।কালের বিনাশী শক্তির কাছে আমরা প্রত্যেকে পরাজয় স্বীকার করেছি।জীবনকে বিকাশের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবার বদলে আমরা প্রত্যেকে হয়ে পড়েছি জীবনের পিঠে দুর্বহ বোঝা স্বরূপ।আঁদ্রে মালরোর Man’s Estate উপন্যাসটা পড়েছ? পড়ো।আমি দেব তোমাকে।ব্যর্থ বিল্পবের পরে তাঁর উপন্যাসের চরিত্রগুলো মানবিক পরিস্থিতিকে অতিক্রম করবার জন্য নানা পথের আশ্রয় নিচ্ছে।ফেরেল মুক্তি পাচ্ছে সেক্সের মধ্যে,ক্লেপিক জুয়া খেলার মধ্যে চেষ্টা করছে কালহনন আর আত্মবিস্মরণের। চেন খুঁজে পাচ্ছে হিংসা আর রক্তপাতের মাদকতা।আর বুড়ো গিসরের জন্য আছে আফিমের নেশা। আর আমরা?... আমার কথা শুনে শুনে তোমার ঘুমই এল।মাফ কর,তোমার অনেক সময় নষ্ট করলাম।আজ এ কথাগুলো আমার কাউকে বলার ভীষণ প্রয়োজন হচ্ছিল।আর কিছু না হলেও বুকটা বড় হাল্কা লাগছে। যাই হে! রাত অনেক হল।”

প্রভাতের আপত্তিতে কান না দিয়ে প্রহ্লাদ প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে গেল।

(ক্রমশ...)