শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪

জমাট বাঁধা রক্ত,পর্ব -১

প্রস্তাবনা-জমাট বাঁধা রক্ত (গোটা তেজর সার)উপন্যাসের পটভূমি ১৯৭২ সনের অসমের ‘মাধ্যম আন্দোলন’।উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মহাবিদ্যালয় তথা বিশ্ববিদ্যালয়ে অসমিয়া ভাষা মাধ্যম করার আন্দোলনই ছিল ‘মাধ্যম আন্দোলন’।এই আন্দোলন অসমের সমাজ জীবনকে কীভাবে প্রভাবিত করেছিল তারই এক আংশিক চিত্র আমরা উপন্যাসে দেখতে পাব।রাজনৈতিক চক্রান্তে সুবিধাবাদীর দৌরাত্মে সর্বসাধারণ মানুষকে চিরকালই লাঞ্ছনা ভোগ করতে হয়।নতুন প্রজন্ম হাজার নিরাশা,বিপদের মধ্যেও আশার স্বপ্ন দেখে।এই আশার স্বপ্নই উপন্যাসটিকে এক উজ্জ্বল সম্ভাবনা ময় ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে।

উপন্যাসটির নামকরণ সম্পর্কে লেখক নবকান্ত বরুয়ার কবিতা ‘ভাষা জননীর সলিলকি’নামে কবিতার একটি পঙক্তি –‘হে রাজনৈতিক মালীরা,ওদের জমাট রক্তের সার না দিলেও গোলাপ ফুল ফুটবে’র কথা বলা হয়েছে। উপন্যাসটির বীজ রয়েছে কবিতার এই পঙক্তিতে।


এক

সে কতক্ষণ ঘুমিয়েছিল বলতে পারি না। হঠাৎ রেলের ঝাঁকুনিতে পবিত্র জেগে উঠল। ধড়মড় করে উঠে বসে ঘড়ির দিকে তাকাল। পাঁচটা বাজে।

তার মানে তার নামার সময় হয়েছে।সারাটা রাত রেলে এসেছে।রেলের ঝাঁকুনি,স্টেশন গুলিতে হওয়া হট্টগন্ডগোল, তাছাড়া ঘুমিয়ে পড়লে কোথাও চুরি হওয়ার আশঙ্কায় মধ‍্য রাত পর্যন্ত তার ঘুম এল না। শেষ রাতে কখন যে তার দুই চোখে ঘুম জড়িয়ে এসেছে তা সে নিজেই বলতে পারল না।

সেই জন্য সে চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। তৃতীয় শ্রেণীর কামরাটিতে সবকিছু ঠিকই আছে। সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কেবল একজন মাড়োয়ারি লোক প্রাতঃকৃত্য সম্পন্ন করে পায়খানা থেকে বেরিয়ে আসছে।

পবিত্র বেঞ্চের নিচে একবার তাকিয়ে দেখল।ট্রাঙ্কটা আগের জায়গাতেই রয়েছে।পকেটে হাত দিল। বেশি পয়সা না থাকলেও পকেটের যে কয়টি টাকা ছিল ঠিকই আছে। এবার সে শোয়া থেকে উঠে বসল। তারপরে জানালাটা খুলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে এক ঝাঁক ঠান্ডা বাতাস ভেতরে চলে এল। বাইরেটা দেখা যাচ্ছে না। কুয়াশা। আশ্বিন মাসের সকাল বেলা। দিনে গরম যদিও শেষ রাতে ঠান্ডা পড়ে। একটা পাতলা চাদর গায়ে নিতে ইচ্ছা করে।

সে বাইরের দিকে তাকিয়ে আভাস পেতে চেষ্টা করল কোথায় এসে পৌঁছেছে। না সে কিছুই বুঝতে পারল না। তবু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল তার গন্তব্য স্থানে পৌছাতে আর বেশি দেরি নেই। সেই জন্য সে জানালাটা বন্ধ করে উঠে বসল। তারপরে বিছানা গোছাতে লাগল।

বিছানাটা হোল্ডঅলে বেঁধে নিয়ে সে বাথরুমে গেল।চোখ দুটিতে জল দিয়ে ভালো করে করে ধুয়ে মুছে নিল। বেসিনটাতে মুখটা টেপের জলে ধুতে ঘৃণা হল। বেশি দেরি নেই, স্টেশনে নেমে গিয়ে মুখ হাত ধুয়ে নিতে পারবে।

পবিত্র জিনিসগুলি আবার ভালো করে দেখে নিল। তারপরে বেঞ্চের নিচে ঢুকিয়ে রাখা ট্রাঙ্কটা টেনে বের করে আনল।ট্রাঙ্কটা বেশ ভারী। বইপত্র থেকে শুরু করে কাপড় চোপড় সমস্ত কিছুই সে ভরিয়ে এনেছে।অন্যান্য বছর ছুটিতে এলে সে সব জিনিস নিয়ে আসে না। হোস্টেলে রেখে আসে। চৌকিদার এবং হোস্টেল সুপার কে বলে আসে।

এবারের কথা আলাদা। সুপারও বললেন সমস্ত কিছু নিয়ে যেতে। তাছাড়া এটা তো গন্ডগোলের আরম্ভ মাত্র। কবে শেষ হবে কে জানে?

পবিত্র এবার তার ডান দিকের বেঞ্চে শুয়ে থাকা অনিমেষের দিকে তাকাল। সুন্দর মুখটার দিকে তাকিয়ে খারাপ লাগল।অনিমেষ রায়। তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু,রুমমেট।

পবিত্র পুনরায় একবার অনুভব করতে লাগল- গন্ডগোলটা শুরু হতেই এত দিনের পুরোনো বন্ধু দুজন কীভাবে পর হয়ে গিয়েছে। আগে ব্যক্তিগত সমস্যা থেকে আন্তর্জাতিক সমস্যা' পর্যন্ত তারা সবকিছুই এক সঙ্গে আলোচনা করত, তর্ক করত। অবশেষে তারা একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে না পারা পর্যন্ত তর্ক বা আলোচনা শেষ করত না। কিন্তু এত বড় একটি সমস্যা নিয়ে এতগুলি সভা-সমিতি হয়েছে, আন্দোলন হয়েছে, অবশেষে কর্তৃপক্ষ কলেজ স্কুল বন্ধ করে দিয়েছে। তবুও দুটি অভিন্ন হৃদয়ের বন্ধু একই ঘরে থেকে আগের মত তর্ক করতে আলোচনা করতে সাহস করতে পারেনি। কে জানে সেন্টিমেন্টকে আঘাত করে কিনা, কে জানে সংকীর্ণ মনোবৃত্তি বলে মনে করে যদি ঠিক এই জন্যই পবিত্র এবারও এই বিষয়ে অনিমেষের সঙ্গে আলোচনা করতে সাহস করেনি। অনিমেষও আগের মতো তার সঙ্গে তর্ক জুড়ে দেয় নি। সে বড় সাবধানে প্রসঙ্গটি এড়িয়ে গিয়েছে। সে হয়তো ঠিক একই কমপ্লেক্সে ভুগছে।

এই দুদিনে এত আপন বন্ধু দুটি কীভাবে এতটা পর হয়ে গেল, কথাটা ভেবে পবিত্রের পুনরায় একবার খারাপ লাগল। ভুল বোঝার আশঙ্কা,সেন্টিমেন্টকে আঘাত করার আশঙ্কা-এই ধরনের নানা শঙ্কা এবং দ্বিধাগ্রস্ততা দুজন কে এভাবে ঘিরে ফেলল যে একে অপর থেকে একেই ঘরে থেকেও যেন সবসময়ের জন্য সশস্র মাইল দূরে সরে গেল। দু'জনকেই যেন একে অপরের থেকে সরে থাকতে বাধ্য করা হল।

কিছুক্ষণ পরেই দুজনের ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে। কতদিনের জন্য ছাড়াছড়ি হবে সেটা তারা জানেনা। গুয়াহাটি থেকে পুরো রাস্তাটা একসঙ্গে এসেছে। ঠিক যন্ত্রচালিত মানুষের মতো দুজনেই নিজের নিজের কাজ করছে। কিন্তু আগের মতো ফুর্তি নেই। কী এক ভয় এবং শঙ্কা।এই শঙ্কা জীবনের নয়। এই শঙ্কা আপনজনকে আঘাত করার শঙ্কা। তার আত্মবিশ্বাস আছে যে সে থাকা পর্যন্ত অন্তত অনিমেষকে কেউ শারীরিকভাবে আক্রমণ করতে পারবে না। কিন্তু তার উপস্থিতিতে ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত ভাবে যদি কেউ কোনো না বলা কথা বলে যায়- তখন কী হবে?

তাছাড়া সবচেয়ে বড় কথা সমগ্র কলেজটা তথা ছাত্র সম্প্রদায় যেহেতু আন্দোলনে নেমে পড়েছে সেক্ষেত্রে পবিত্রের মতো একটি ছেলে একেবারে নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকতে পারে না।দুই একদিন সভা-সমিতিতে গিয়েছে। একদিন এমনকি তার সঙ্গে অনিমেষও গিয়েছে। অনিমেষ কিছু বলেনি, কেবল একজন নীরব শ্রোতা। সভা থেকে ফিরে আসার পথে বিনয় দুয়ারা অনিমেষকে কেবল জিজ্ঞেস করেছিল,-‘আচ্ছা অনিমেষ এই আন্দোলন সম্পর্কে তোর অভিমত কি? আমি কিছুই মনে করব না, আমি স্পষ্টভাবে বলছি অসমিয়া-বাংলা কোনো মাধ্যম চাইনা। ইংরেজিই থাকুক,আফটার অল ইংরেজি আমাদের লাগবেই, অন্তত আগামী ১০০ বছর পর্যন্ত কোনো ভারতীয় ভাষা ইংরেজির সমান হতে পারবে না…’

বিনয়ের সুদীর্ঘ বক্তৃতাটা শুনে অনিমেষ নিস্তেজ হাসি হেসে বলেছিল এখন তো পুরো সমস্যাটা আর মাধ্যম সমস্যা হয়ে নেই। এটা একটা রাজনৈতিক সমস্যায় রূপান্তরিত হয়েছে। তাই আমার এই বিষয়ে একটাই উত্তর রয়েছে। শোষকের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য পৃথিবীতে যেকোনো একটি ভাষা হলেই হল। আসলে জান বিনয়, পৃথিবীতে এখন মাত্র দুটো ভাষাই আছে। একটি শোষকের ভাষা এবং অন্যটি শোষিতের ভাষা। এই দুটি মাধ্যমের কোনটি তোর প্রিয় মাধ্যম নিজেই বিচার করে দেখ। তাই আমার পিতার জন্য যা প্রিয় মাধ্যম সেটা আমার প্রিয় মাধ্যম না ও হতে পারে…’

‘মানেটা স্পষ্ট’-অনিমেষ বলল,’আমার বাবা হলেন পুঁজিপতি মালিকের একটি চা বাগানের ম্যানেজার। অসমিয়া তো দূরের কথা আমি বাংলা ভাষাতে কথা বললেও বাবা সহ্য করতে পারেন না। শৈশবে আমি বাংলা ভাষায় কথা বলতাম না। বড় হওয়ার পরে আমার পক্ষে অসমিয়া ভাষায় কথা বলা, লেখাপড়া করতে যেমন কষ্ট হয়েছিল বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও ঠিক ততটাই কষ্ট হয়েছিল। বাবা আমাকে সেন্ট স্টিফেন্সে পড়াতে চেয়েছিলেন। আমি দিল্লিতে যাব বলে এসে বাড়ির অমতে কটন কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। কিন্তু আমার বাবাকে কেউ যদি জিজ্ঞেস করে বাবা এককথায় অসমিয়ার সঙ্গে বাংলা ভাষাও মাধ্যম হওয়া উচিত বলে দাবি করবেন। এর কারনকি জান? শ্রেণিস্বার্থ।অবশ্য এই শ্রেণিস্বার্থ অসমিয়া বা বাংলা ভাষার জন্য নয়।এই শ্রেণিস্বার্থ শোষক শোষিতের উপর চালানো শ্রেণিস্বার্থ। অবশ্য আমার বাবা সোজাসুজি ভাবে শোষকের শ্রেণিতে পড়েন না।He is the agent of Exploiters।তাই নিজের মালিকের স্বার্থের জন্য তিনি সমস্ত কাজই করবেন…Please don’t mind। তোরা জিজ্ঞেস করেছিস বলেই বলছি- যতদিন পর্যন্ত শোষিত শ্রেণি একই ভাষায় কথা বলতে শিখবে না,যতদিন পর্যন্ত মাত্র একটি ভাষায় নিজের ন্যায্য দাবী করতে শিখবে না ততদিন পর্যন্ত এই সমস্ত সমস্যা থেকে যাবে। অবশ্য এই ভাষা অসমিয়া বা বাংলা ভাষা নয়, এই ভাষা হল সর্বহারার ভাষা…’

আঃ অনিমেষ’- বিনয় প্রতিবাদ করে উঠল। তুই বাস্তব সমস্যা এড়িয়ে গিয়ে এদিক ওদিক চলে যাচ্ছিস। আমি, বর্তমান পরিস্থিতিতে এই সমস্যাটা নিয়ে কীভাবে ভাবছিস তাই জানতে চেয়েছি। ভয় করিস না, আমাদের সেন্টিমেন্টকে আঘাত করা কথা বললেও আমরা খারাপ পাব না, এমনকি ভবিষ্যতে তোর অনুপস্থিতিতে কখনও কোথাও আলোচনা করব না…’

‘ না, না আমি ভয় করছিনা। অনিমেষ বলল, অবশ্য পারতপক্ষে আমি এই সমস্যা সম্পর্কে কথা বলার মতো অবস্থা থেকে দূরে চলে এসেছি… আজ কোথাও কোথাও কলকাতা থেকে প্রকাশিত কাগজ পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তার মানে এটা আন্দোলনের প্রথম পর্ব শুরু হল। এরপরে আরম্ভ হবে ঘর পোড়ানো, মানুষের মৃত্যু ইত্যাদি। কিন্তু যে কলকাতার কাগজে আজ অসমে বাঙালির জন্য এত কান্না কাঁদছে তারা এতদিন অসমের বাঙালির জন্য কী করেছে? আজ যদি অসমের কোনো একজন বাঙালি লেখক একটি ভালো উপন্যাস,একটি ভালো গল্প বা একটি ভালো কবিতা লিখে পাঠায়, সেই গল্প, কবিতা, উপন্যাস কলকাতার প্রথম শ্রেণির কাগজে পত্র পত্রিকায় প্রকাশ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই …তোদের অসমিয়া পাঠ্যপুথি,নোটসের কথা বলছিনা- গল্প কবিতা উপন্যাসের প্রকাশক ও কলকাতার বাঙালি প্রকাশক। কিন্তু এরকম একজন প্রকাশককে কোনো একজন অসমের বাঙালি একটি ভালো উপন্যাস লিখে পাঠালে সেই উপন্যাস প্রকাশ করবে কি? কখনও করবে না। কারণ ভাষা-সাহিত্যের প্রেমের নামে ব্যবসায়ে তারা রিক্স নিতে চায় না। এখানে মুনাফার প্রশ্ন জড়িত হয়ে রয়েছে। আমার বাবার বাঙালি প্রীতি ঠিক একই পর্যায়ের। আমার বাবার নিজের ছেলেকে ইংরেজি স্কুলে পড়িয়ে বাংলা ভাষার মাধ্যম সমর্থন করা এবং এই সমস্ত লোকের অসমে বাঙালির জন্য কাঁদার অন্তরালে একই শ্রেণীর স্বার্থ জড়িত হয়ে রয়েছে। আমি নিজে বাঙালি বলে যে সমস্ত আমাদের দোষের কথা বলেছি ঠিক সেইরকম দোষ অসমিয়া সমাজেও রয়েছে।… আফটার অল,এটা একটি বুর্জোয়া সমস্যা। কিন্তু আমার দুঃখ কোথায় জানিস,এর ভিকটিম হবে সাধারণ ছোট ছোট মানুষ, যাদের জীবনে দুবেলা-দুমুঠো খেতে পারাটাই একমাত্র সমস্যা। ওদের ভাষা একটাই এবং সেই ভাষা পেট থেকে বের হয়, মুখ থেকে নয়। আমি আমার বাবা কাজ করা বাগিচার মজদুর বস্তি দেখেছি।…’মজদুর বস্তির কথা বাদ দিচ্ছি কারনে ট্রেড ইউনিয়নের জন্য আজকাল মজদুর ছেলেমেয়ে শিক্ষার অনেক সুযোগ সুবিধা পেয়েছে। বাগিচার কাছে থাকা গ্রামগুলিতে আমি গিয়েছি, সেখানে দুই তিনটি গ্রামের মধ্যে থাকা একটি এলপি স্কুল দেখেছি যেখানে কেবল ‘ক’শ্রেণি থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত একজন শিক্ষকই পড়ান,যেখানে অসমিয়া, বাঙালি মজদুর ছেলে একই ভাষায় শিখে… সেখানে, সেই রকম জায়গায় কলেজে কী ভাষায় শিক্ষা দান করা হয় সেটা সমস্যা নয়, ওদের সমস্যা হল দুটো অক্ষর শিখতে পারাটা, কিন্তু আজ আমরা নগরে যে আন্দোলন আরম্ভ করেছি তার বলি কারা হবে জানিস? সেই ছোট ছোটমানুষগুলির একটাই মাধ্যম। ওদের দুটো মাধ্যম থাকতে পারে না…’

সেদিন কথা বলতে বলতে অনিমেষ কিছুটা উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল। সেই উত্তেজিত মুখটা ঘুমের মধ্যে কত শান্ত।ঘুমিয়ে থাকাঅনিমেষের দিকে তাকিয়ে পবিত্রের খুব খারাপ লাগল।

গন্ডগোলটা যত বেশি হতে লাগল অনিমেষ ততই কথা বলা বন্ধ করে দিল। সেদিনের পর থেকে কারও সঙ্গে এই বিষয়ে তাকে আলোচনা করতে দেখা যায়নি।

অবশ্য একদিন দুটি বাঙালি ছেলে এসেছিল বলে পবিত্র শুনেছে। তারা অনিমেষের সঙ্গে আলোচনা করতে চেয়েছিল। অন্য কোনোখানে ডেকে নিয়ে গিয়ে তার সঙ্গে আলোচনা করতে চেয়েছিল। অনিমেষ তাদেরকে বলেছিল-‘তোমাদের কী আলোচনা করার আছে, এখানেই কর। আলাদা গোপন আলোচনা করার মতো আমার কিছু নেই। আমি এখনও আমার রুমমেট বা অন্যান্য অবাঙালি বন্ধুদের উপরে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলি নি। আমি জানি আমার যতদিন পর্যন্ত বিশ্বাস থাকবে ততদিন পর্যন্ত আমার ওপরে ওদেরও আস্থা থাকবে…।

অনিমেষের এই ধরনের সোজাসুজি কথায় তার বাঙালি বন্ধুরা কিছুটা ক্ষুন্ন হয়েছিল। ওরা ভেবেছিল সে জাতির শত্রু। বিশেষ করে পবিত্রের উপস্থিতিতে অনিমেষ এভাবে বলে দেওয়ায় ওরা কিছুটা বিব্রত হয়েছিল। তা দেখে পবিত্র বলেছিল-‘আপনারা কী আলোচনা করবেন, এখানেই করুন। আমি একটু দূরে সরে যাচ্ছি। চিন্তা করবেন না,আমি এই বিষয়ে কাউকে কিছু বলব না। অন্য কেউ শুনলে একটু অন্য কিছু ভাবতে পারে… এরকম একটি পরিবেশে কিছুটা ‘ইনসিকিউরিটি ফিল’ করা স্বাভাবিক। এরকম ক্ষেত্রে নিজেদের মধ্যেও আলোচনা ইত্যাদি হওয়া প্রয়োজন…’

‘ না না, আপনি থাকুন’, ছেলেগুলি একসঙ্গে প্রতিবাদ করে উঠল,‘আমাদের কোনো গোপন কথা নেই, আপনি থাকুন…’

পবিত্র সেই বাধা না মেনে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল, প্রায় একঘন্টা পরে নিজের ঘরে ফিরে এসে সে দেখেছিল- অনিমেষ যেন কিছুটা বিমূঢ় হয়ে পড়েছে। কিছু একটা চিন্তা করছে এবং ভেতরে ভেতরে বেশ উত্তেজিত হয়ে রয়েছে।

পবিত্র ‘কী হয়েছে’ বলে জিজ্ঞেস করতে গিয়েও জিজ্ঞেস করল না। তার জিজ্ঞেস করতে খারাপ লাগল। কিছুক্ষণ এভাবে পার হয়ে যাওয়ার পরে হঠাৎ অনিমেষ তাকে জিজ্ঞেস করল-‘ আচ্ছা পবিত্র, তুই…তুই কি আমার বুকে ছুরি বসিয়ে দিতে পারবি?’

‘কী!’ একেবারে অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন একটা শোনার মতো পবিত্র চিৎকার করে উঠল,‘কী বলছিস তুই?’

হঠাৎ করে পবিত্র এত বেশী উত্তেজিত হয়ে পড়ল যে কিছুক্ষণ পরে তার নিজেরই লজ্জা হল। অন্য একটি পরিবেশে কিছুদিন আগের কথা হলে সে এভাবে উত্তেজিত না হয়ে উঠে হো হো করে হেসেবলতে পারত,হ্যাঁ,পারব, কেন পারব না?’

কিন্তু এরকম একটি পরিবেশে পবিত্রের সেই ধরনের কোনো কৌতুক করার মতো সাহস হল না। কিছুক্ষণ নীরবে বসে থাকার পরে অনিমেষ বলল-‘আমাদের হোস্টেলের বাঙালি ছেলেরা এক ধরনের ইনসিকিউরিটি ফিল করছে…’

‘সেটাই স্বাভাবিক কথা’, পবিত্র বলল কিন্তু আমি ভাবি হোস্টেলে ভয় করার মতো, অন্তত আমরা থাকা পর্যন্ত…’

‘সেটা ঠিক’ অনিমেষ বলল, কিন্তু ইতিমধ্যে বাইরে থেকে অনেকে ইনস্টিগেট করছে।…’

আত্মরক্ষার জন্য দুই-একজন ছুরি, এসিড বাল্ব…’

‘কি! আশ্চর্য হয়ে আমি ভয় পাওয়ার মত চিৎকার করে উঠলাম।

‘ চিৎকার করিস না’ অনিমেষ বলল, আমাদের খুব সাবধানে থাকতে হবে। তুই কথাগুলি কারও সামনে বলিস না। অন্য কেউ জানতে পারলে বিরাট গন্ডগোল হবে…’ অনেক ছেলেরই নিজেদের কোনো চিন্তা শক্তি নেই। বাইরে থাকা কিছু সুবিধাবাদী মানুষ চায় গণ্ডগোল হোক …ওরা এদের মনে ‘প্যানিক’সৃষ্টি করেছে। ওরা ভাবে এভাবে মরার চেয়ে দুই-একটিকে নিয়ে মরা বেশি ভালো। তাছাড়া জানিসই তো বাঙালির ছেলে একটু বেশি আবেগিক, শুদ্ধ করে বাংলা ভাষা লিখতে না পারলেও অথবা বাংলা সাহিত্যের বিষয়ে কোনো কিছু না জানলেও রবি ঠাকুরের ভাষার নামে জীবন বিসর্জন দিতে পারে…’

এরপর সেদিন থেকে দুজনেই এই বিষয়ে আলোচনা করে নি। বেশি অনুসন্ধিত্সু হয়ে পড়লে সে হয়তো আঘাত পাবে।সেই ভয়ে পবিত্র অনিমেষকে কিছুই জিজ্ঞেস করে নি। পবিত্র লক্ষ্য করেছে ধীরে ধীরে হোস্টেলের ছেলেগুলি দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। পরস্পর পরস্পরকে সন্দেহ করতে আরম্ভ করেছে। পবিত্র এবং অনিমেষের দুজনেরই মুশকিল হয়েছে ঠিক সেখানেই। কারণ একজন ও নিজের নিজের শিবিরে যোগ দিতে পারেনি। কিন্তু মুখ খুলে কাউকে কিছু বলতেও পারেনি। কারন দুজনেই জানে এই অবস্থায় যুক্তি কোনো কাজ করে না। তাছাড়া ওরা করতে পারা কাজও একেবারে সীমাবদ্ধ। দুজনেই কেবল আশা করছে হোস্টেলে অবাঞ্ছিত কিছু একটা ঘটে না গেলেই হয়। ঠিক এই সময় কর্তৃপক্ষ কলেজ বন্ধ করে দিল। পবিত্র এবং অনিমেষ কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।চব্বিশঘন্টার ভেতরে হোস্টেল ছেড়ে বাড়ি ফিরে যাবার জন্য নির্দেশ অনুসারে ওরা দুইজনই ঠিক করল- রাতের কামরূপ এক্সপ্রেসে বাড়ি ফিরে যাবে। পবিত্র পুনরায় আবার জানালাটা খুলে দিল। কুয়াশার মধ্য দিয়ে খুব ক্ষীণ ভাবে সূর্যের রশ্মি ভেসে এল। সে পুনরায় একবারঘড়ির দিকে তাকাল। হাতের ঘড়ি এবং রেলপথের পাশের মাঠের দিকে তাকিয়ে সে সময়ের কত পেছনে এবং তার গন্তব্য স্থান পেতে কতটা সময় লাগতে পারে তার একটা আন্দাজ করে নিল। খুব বেশি সময় নেই। খুব বেশি পনেরো মিনিট। একবার সে ভাবল অনিমেষকে জাগিয়ে দেবে নাকি? তারপরে ঠিক করল-থাক শুয়েছে যখন শুয়ে থাক।নামারঠিক আগে আগে ডেকে দিলেই হবে।

হঠাৎ রেলটা খুব জোরে হুইসেল দিতে আরম্ভ করে স্পিড কমিয়ে দিল। সম্ভবত সিগনাল নেই। এত ছোট স্টেশন যে কেবল একজন স্টেশন মাস্টার এবং একজন পয়েন্টসমেন শুরু থেকে কাজ চালিয়ে আসছে। দুজনেরই চব্বিশ ঘন্টা ডিউটি। হঠাৎ পয়েন্টসমেন কোথাও গেলে স্টেশন মাস্টারকে সিগনেল দেওয়া থেকে শুরু করে সমস্ত কাজ করতে হয়। আগে মেইল, এক্সপ্রেস ট্রেন এখানে কিছুই থামত না, কিন্তু পাশের এক বৃহৎ অঞ্চলের লোকদের যোগাযোগের অন্য কোনো সুবিধা না থাকায় অনেক আবেদন-নিবেদনের পরে মাত্র ত্রিশ সেকেন্ডকামরূপ এক্সপ্রেস এখানে দাঁড়ানো শুরু করেছে।

ট্রেইনের হুইসেলে অনিমেষের ঘুম ভেঙ্গে গেল। পবিত্রকে বেডিং, ট্রাংক দরজার সামনে নিয়ে যেতে দেখে সে জিজ্ঞেস করল-‘ কী হল তোর, তোর নামার সময় হয়েছে নাকি?’

‘হ্যাঁ, পবিত্র বলল, আউটার সিগনেলে ঢুকে গেছি…’

‘ তুই আমাকে একটু আগে ডেকে দিলি না কেন?’ কিছুটা অপরাধীর মতো অনিমেষ বলল-হঠাৎ কীভাবে যে ঘুম এসে গেল বলতে পারি না।’ তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,ইস,অনেক সময় ঘুমোলাম…’

‘তোকে আমি না বলেই চলে যাব ভেবেছিস নাকি?’পবিত্র বলল,‘তুই যেভাবে ঘুমিয়ে ছিলি সেভাবে তোকে বহুদিন ঘুমোতে আমি দেখিনি। প্রায় রাতেই যে তোর ঘুম হত না আমি ঠিক বুঝতে পেরেছিলাম। তখন আমার নিজেকে বড় অপরাধী মনে হত…’

‘ কেন তুই অসমিয়া বলে?’ অনিমেষ সশব্দে হেসে উঠল, অসমিয়া রুমমেট! একটি বাঙালি ছেলে রুমমেট হলে যতটুকু শুয়ে ছিলাম তাও শুতে পারতাম না…’ তুই রাতে শুয়ে থাকার সময় আমার গলা কাটবি বলে ভয় পাইনি।গলা যদি কাটতে বেরিয়েছি আমরা নিজেরাই নিজেদের গলা কাটতে বেরিয়েছি। তুই আমার বা আমি তোর গলা কাটার প্রয়োজন নেই…

‘ আচ্ছা বাদ দে এসব’ পবিত্র বলল, আমার নামার সময় হয়েছে, বিদায়ের সময় এ সমস্ত সিরিয়াস কথা বলে মনটাকে বিষণ্ন করার কোনও অর্থ নেই …’

ধীরে ধীরে ট্রেইনের স্পিড একেবারে কমে গেল। দূরে স্টেশনটা জানালা দিয়ে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। পবিত্র দরজাটা খুলল। অনিমেষ তার বেডিংটা এবং ট্রাঙ্কটা আরও কিছুটা দরজার দিকে ঠেলে দিল।

রেলটা থেমে গেল। ধীরে ধীরে দুজনে ধরাধরি করে ট্রাঙ্কটা এবং বেডিংটা নামিয়ে নিল।

‘জিনিসগুলি তুই কীভাবে নিয়ে যাবি?’অনিমেষ জিজ্ঞেস করল, এখান থেকে তোর গ্রাম তো বহুদূর?’

‘ হ্যাঁ’, পবিত্র বলল,চার মাইল, আগে আসার আগে খবর দিয়ে দিই,বাবা একটা গরুর গাড়ি একটা পাঠিয়ে দেয়, এবার কোনো খবর না দিয়েই চলে এসেছি…আচ্ছা,ধর,স্টেশনের বারান্দাতে প্রথমে নিয়ে যাই…’

দুজনে ধরাধরি করে জিনিসগুলো স্টেশনের বারান্দায় নিয়ে ঠিক করে রাখামাত্র রেলের হুইসেল দিল।

‘আমি যাই’ এই বলে কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করে অনিমেষ তার কামরার দিকে দৌড়ে গেল। ইতিমধ্যে রেল চলতে শুরু করেছে। পবিত্রও অনিমেষের পেছনে পেছনে কিছুটা দূরে গিয়ে চিৎকার করে বললঃ‘পৌঁছানোর পরে খবর দিস।’

রেলে লাফ মেরে উঠে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অনিমেষ কেবল হাত নাড়ালো। পবিত্রের মনে হল যেন অনিমেষের চোখ দুটো ভিজে উঠেছে।ধীরে ধীরে রেলটা স্টেশন পার হয়ে গেল। অনিমেষ দৃষ্টির বাইরে চলে না যাওয়া পর্যন্ত সে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকল।পবিত্রেরওমনে হল যেন তারও চোখদুটি কিছুটা ভিজে উঠেছে।

এর আগেও কয়েকবার দুজনেই এভাবে এই স্টেশন থেকে বিদায় নিয়েছে। কিন্তু কোনো দিন এরকম মনে হয়নি। আজ তার চোখ দুটো কেন ছল ছল হয়ে এল সে নিজেই বলতে পারল না।

রেলটা যখন একেবারে চোখের আড়ালে চলে গেল পবিত্র ধীরে ধীরে স্টেশনের দিকেএকপা দুপা করে এগোতে লাগল। স্টেশনে বিশেষ কোনো মানুষ নেই। সকালের গাড়ি থেকে অন্য কোনো মানুষকে নামতে সে দেখতে পেল না।পবিত্রের মনে হল যেন দীর্ঘ রেলযাত্রার সমস্ত ক্লান্তি এসে তাকে চেপে ধরেছে।