শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪

চমৎকার চকৌরি

চমৎকার চকৌরি..

বিনসর ইকো ক্যাম্প থেকে আমরা বেরিয়ে পড়লাম সকাল সকাল,রমেশজী আর চন্দন কে বিদায় জানিয়ে।আজকের গন্তব্য চকৌরি ভায়া পাতাল ভুবনেশ্বর!!

সুদীর্ঘ পথ।মাঝেমধ্যে পথের ক্লান্তি ভুলিয়ে দিচ্ছে এক একটা পথের বাঁক।যেখান থেকে শ্বেতশুভ্র শৃঙ্গরাজি উঁকি মেরে যাচ্ছে।আর আমাদের শিরায় শিরায় শক্তি সঞ্চার করে যাচ্ছে।

তবে প্রতিদিনের ক্লান্তিকর জার্নি আজ অল্প হলেও থাবা বসাচ্ছে আমাদের শরীরে।গাড়ি থামিয়ে মাঝে মাঝে মিসেস কে আর ছেলেকে চোখেমুখে জল দিয়ে আর ওষুধ খাইয়ে পরিচর্যা করতে হচ্ছে।আমি এখনো অবধি ঠিক আছি।ভগবানের আশীর্বাদে পাহাড়ি পথে আমি এখনো অবধি অতটা অসুস্থ হই নি।

যাই হোক,,,,এইভাবে চলতে চলতে এসে পড়লাম পাতাল ভুবনেশ্বর!প্রবেশপথের বাইরে দোকান থেকে পুজোর উপাচার কিনে নিয়ে চললাম।আশেপাশে বেশ কিছু লজ,হোম স্টে'র দেখা মিলল।কুমায়ুনের যাত্রাপথে এটি একটি অন্যতম দ্রষ্টব্য স্থান!পুরাণ মতে তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর বাস এই গুহা গর্ভে।কথিত আছে আদি শঙ্করাচার্য প্রথম এই গুহামন্দিরে পূজাপাঠ চালু করেন।

পূজার ডালি নিয়ে এগিয়ে চললাম পায়ে পায়ে।আমরা আগেই ঠিক করে নিয়েছিলাম যে গুহাগর্ভে প্রবেশ করব না!ছেলে আর মিসেসের শরীর ভাল ছিল না আর ওদের একা রেখে আমার পক্ষেও নীচে নামা অসম্ভব ছিল!গুহামন্দিরের প্রবেশপথ দেখলেও বুক শুকিয়ে যায়।খুব সঙ্কীর্ণ এবং মাথা নীচু করে হামাগুড়ি দিয়ে প্রবেশ করতে হয়।

যাই হোক,বাইরের ছোট্ট মন্দিরে পূজারীজির কাছে পুজা দিয়ে আমরা ফিরে চল্লাম।পূজারীজি হাল্কা তিরস্কার করলেন,,,"আরে দাদা!কুছু হবে না।নীচে যান না!"প্রচুর বাঙ্গালী পর্যটকদের সংস্পর্শে এসে ওনার বাংলাটা কিন্তু জবরদস্ত হয়ে উঠেছে!আমরা হাসিমুখে আমাদের অক্ষমতার কথা জানিয়ে চলে এলাম।

আবার গাড়ি ছুটল,,,,চকৌরি আরও প্রায় ৩৯ কিমি দূরে।আমাদের গন্তব্য হোটেল ওজস্বী।কে এম ভি এন এখানকার থাকার জায়গাগুলির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ।তবে এযাত্রা আমাদের ঠাঁই হতে চলেছে হোটেল ওজস্বীতে।

দেখতে দেখতে চলে এলাম হোটেলে।সুন্দর ছিমছাম হোটেল।দীর্ঘযাত্রা শেষ হতে সবাই বেশ খুশি হয়ে উঠেছিলাম।ছেলে আর মিসেস ও অল্পবিস্তর সুস্থ হয়ে উঠেছিল।ক্ষিদেয় পেট চুঁইচুঁই করছিল সবার।ছেলের ইচ্ছে হল চাইনিজ খাওয়ার।সেইমত হোটেল রুমে লাঞ্চ আনিয়ে খেয়ে নেওয়া গেল!বাসনকোসন রুমের বাইরে নামিয়ে রেখে দিবানিদ্রার আয়োজন করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লাম সবাই।ওরা ঘুমিয়েও পড়ল।আমার ঘুম আসছিল না।সামনে বিরাট বাগান আর একটা প্রশস্ত বারান্দা মত সাজানো জায়গা।ভিউ পয়েন্ট গোছের।আমি ওইখানে দাঁড়িয়ে চারিদিকের দৃশ্যসুখ উপভোগ করছিলাম।চকৌরি কে বলা হয় কুমায়ূনের মাউন্টেন গ্যালারি।কিন্তু আজ আকাশ সাদা পেঁজা তুলোর মত কুন্ডলী পাকানো মেঘে ঢাকা।হিমালয় আজ অদৃশ্য!

হঠাৎ পেছনে বিকট আওয়াজ শুনে ঘুরে তাকিয়ে দেখি,,,পর পর বেশ কয়েকটি রুমের বাইরে রাখা বাসনকোসন নিয়ে কাড়াকাড়ি খেলায় মেতেছে এক পাল বানরের দল।পাশেই ঘন জঙ্গল আর গাছপালার সমারোহ।ওনাদের আবির্ভাব ওখান থেকেই ঘটেছে বোধকরি!এমতাবস্থায় আর বাইরে থাকা উচিত না বুঝে আমি পা চালিয়ে আমার ঘরে ঢুকে পড়লাম।তখনও আমার ঘরের সামনে ওনারা নেমন্তন্ন খেতে হাজির হন নি!

এবারে ঘরে বিছানায় গা এলিয়ে একটু ঘুমিয়ে পড়তেই হল।ঘন্টাখানেক বাদে যখন ঘুম ভাঙ্গল তখন প্রায় সাড়ে চারটে বাজে।আস্তে আস্তে বেলা পড়ে আসছে।আমি বাইরে মুখ বাড়িয়ে আর তেনাদের দেখা পেলাম না।ছেলে আর ছেলের মা তখনও ঘুমে অচেতন।আমি ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে দরজা টেনে লক করে বেরিয়ে পড়লাম।

হোটেল রিসেপশনে জিজ্ঞেস করে জানলাম বাইরে বেরিয়ে ডানদিকে অল্প হাঁটলেই সানসেট পয়েন্ট পাওয়া যাবে।আর বাঁ দিকে গেলে পরমহংস আশ্রম।

ঠিক করলাম আশ্রমে কাল সকালে যাব।আপাতত সানসেট পয়েন্টে যাই!বাইরে বেরিয়ে রাজকুমারের সাথে দেখা,আমাদের সারথি!সব শুনে উনিও আমার সঙ্গী হলেন।দুজনে গল্প গল্প করতে চললাম অচেনা পথ ধরে।বেশ মিনিট আষ্টেক হেঁটে এলাম সানসেট পয়েন্টে।সূর্য্য তখন প্রায় ডুবু ডুবু!আমার ছবি তোলার নেশার ব্যাপারে এতদিনে রাজকুমার ওয়াকিবহাল।উনি আমাকে বেশ ক'টা ভাল জায়গা দেখিয়ে সেখান থেকে ছবি তুলতে বললেন।পশ্চিম আকাশে রাঙা কমলালেবুর মত সূর্য্যি মামা অস্ত গেলেন।

আমি আর রাজকুমার হোটেলে ফিরে চল্লাম।

পরের দিন বেরিয়ে যাব মুন্সিয়ারি।তবে পরের দিন ভোরবেলা চকৌরি আমাদের নিরাশ করেনি!!চকৌরির মাউন্টেন গ্যালারি নাম মাহাত্ম্যের প্রমাণ পেয়েছিলাম পরের দিন ভোরেই।

বিনসরের রাতটা ছিল কোজাগরী লক্ষী পূর্ণিমার রাত।গোল থালার মত পূর্ণচন্দ্র উঠেছিল আকাশে।চকৌরির আকাশেও দেখা পেলাম সেই একরকম চাঁদের!!সেই শোভা দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়লাম কখন।

পরের দিন ঘুম ভাঙ্গল বেশ ভোরে।সাড়ে পাঁচটা বাজে।জানালার পর্দা সরিয়ে উঁকি মারলাম বাইরে।অল্প অল্প আলো ফুটবে ফুটবে করছে।গায়ে একটা সোয়েটার চাপিয়ে বেরিয়ে এলাম বাইরে।সামনের সেই ভিউ পয়েন্ট কমন বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম।পূব আকাশ আস্তে আস্তে রাঙা হয়ে উঠছে।লালচে আভা পূব দিগন্ত জুড়ে।সূয্যিমামার ঘুম ভাঙছে আস্তে আস্তে।প্রচুর পাখির কলতানে তখন কান পাতা দায়।চকৌরিতে ভোর নেমে আসছে।

তখনও কি জানতাম দিনের আলো ফুটলে কি অপরূপ দৃশ্য দেখতে পাব!সেই অনুপম ভোরের ছবি ক্যামেরাবন্দী করতে তখন আমি ব্যাস্ত।লালচে থেকে কমলা তারপর আস্তে আস্তে সোনালী রোদ নেমে এল।অস্পষ্ট আলোর আভায় দেখা যাচ্ছিল কাছের পাহাড় গুলোর স্তরের পর স্তর (mountain layers)।রোদ ওঠার পর,,,দূরদিগন্ত জুড়ে দৃশ্যমান হয়ে উঠল হিমালয়ান রেঞ্জ!!সে এক অপরূপ দৃশ্য!!আকাশে গতকালের মত মেঘের চিহ্নমাত্র আজ আর নেই।চকৌরি আজ সত্যিই মাউন্টেন গ্যালারি হয়ে উঠেছে।সার্থকনামা হয়ে উঠেছে!!

এ দৃশ্য তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছিলাম।হঠাৎ কানে ভেসে এল দূর থেকে সুগম্ভীর প্রার্থনা সঙ্গীত।পরমহংস আশ্রম থেকে ভেসে আসা জলদগম্ভীর সেই প্রার্থনা গীতি!মুহুর্তে যেন পরিবেশ হয়ে উঠল ঐশ্বরিক।অনন্যসুন্দর এবং আধ্যাত্মিক যেন সে এক অনুভূতি!!

তবু ঘরে ফিরে আসতে হল তাড়াতাড়ি।সকাল সাড়ে নটা'র মধ্যে চেক আউট করতেই হবে।অনেকটা পথ যেতে হবে আজ মুন্সিয়ারির উদ্দ্যেশ্যে।প্রায় ৯০-১০০ কিমি।

ঘরে এসে তৈরি হয়ে নিলাম দ্রুত।ব্যাগপত্র মোটামুটি গোছানো ছিল আগের রাত থেকেই।মন কিন্তু পড়ে আছে আশ্রমের দিকে।একবার ওদিকটায় যেতেই হবে।অন্তত বেরোনোর আগে।

রেডি হয়ে ঘর ছেড়ে দিয়ে লাগেজ রিসেপশনে রেখে একবার এগিয়ে চল্লাম পায়ে পায়ে পরমহংস আশ্রমের দিকে।হোটেল থেকে বেরিয়ে বাঁ দিকে একটা পায়ে চলা রাস্তা ধরে কিছুক্ষণ এগোলেই আশ্রম পড়ে।আপাতত প্রার্থনা গীতি বন্ধ এখন।আশ্রমের কাছে এসে স্থানুবৎ হয়ে গেলাম।যে হিমালয়ান রেঞ্জ ঘরের বারান্দা থেকে ক্যামেরার জুম বাড়িয়ে দেখছিলাম,,,,আশ্রমের একটু পিছনের অংশ থেকে সেই তাদেরই যেন হাত বাড়িয়ে ছুঁতে পারব!!মনের আনন্দে আমি তখন শুধু ছবি তুলতে ব্যাস্ত।আশ্রমে যাওয়ার কথা ভুলেই গেছি।

চোখ এড়িয়ে

গিয়েছিল,,গাছের আড়ালে দূরের ছোট্ট দোতলা বাড়িটা।

হঠাৎ চটক ভাঙ্গল ঢং ঢং করে ঘন্টার আওয়াজে।কোথা থেকে আওয়াজ আসছে দেখতে গিয়ে দেখি....ওকি!ওটা একটা স্কুল না?সত্যিই তো।এতক্ষণে দূর থেকে কচিকাঁচাদের শোরগোলের আওয়াজ ও শুনতে পেলাম।সকালে স্কুল বসেছে,ছোট্ট বিদ্যার্থীরা স্কুলে আসছে এক এক করে।এই উদাত্ত,নৈসর্গিক পরিবেশের মাঝে স্কুলটিকে দেখে সুনির্মল বসু মহাশয়ের এই কবিতাখানা মনে পড়ে গেল!

"আকাশ আমায় শিক্ষা দিল

উদার হতে ভাই রে,

কর্মী হবার মন্ত্র আমি

বায়ুর কাছে পাই রে।

পাহাড় শিখায় তাহার সমান-

হই যেন ভাই মৌন-মহান,

খোলা মাঠের উপদেশে-

দিল-খোলা হই তাই রে।.."

উদার প্রকৃতির মাঝে এই বিদ্যালয়ে পাঠরত বাচ্চারা যে সঠিক শিক্ষা পাবে,,,তা কি আর আমাদের ইট-কাঠ-পাথরের যান্ত্রিক সভ্যতার স্কুলে দেওয়া সম্ভব?বাচ্চাগুলির কাছে ছুটে চলে যেতে ইচ্ছা করছিল!কিন্তু আমাদের ও গাড়ি ছাড়ার সময় হয়ে গেছে।তাই হিমালয় কে প্রণাম জানিয়ে,বাচ্চাগুলির উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কামনা করে ফিরে চললাম।গন্তব্য মুন্সিয়ারি..