মঙ্গলবার, মার্চ ১৯, ২০২৪

কথাগুলো বলা হলো না --৬

ও ঠাকুমা, বললে না তো তাল কাকে বলে?

তাল কাকে বলে সেটা আমি জানি কিন্তু মায়ের সঙ্গে পন্ডিতদাদুর ওখানে গিয়ে আমারও যে গান-বাজনার জগত সম্পর্কে একটু আধটু জ্ঞান হয়েছে সেটা আজকাল সুযোগ পেলেই অন্যকে জানাতে ইচ্ছে করে আর তাই এই বৃষ্টি বাদলার বিকেলে আমি এখন ঠাকুমাকে নিয়ে পড়েছি। পন্ডিতদাদুর মত দু পা ভাঁজ করে পদ্মাসনে বসে ঠাকুমাকে বলতে শুরু করলাম, বুঝলে তো তাল হচ্ছে গিয়ে আসলে সময়ের ছোট-ছোট ভাগকে ছন্দবদ্ধ ভাবে যন্ত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করবার একটা রীতি, একটু থামি, পন্ডিতদাদুর মুখে শোনা সেদিনকার কথাগুলি একবার যেন মনে-মনে আউড়ে নেই, আর সেই রীতিতে সময়ের পরিমাপ করবার জন্য যে ক্ষুদ্রতম একক বা লয় ব্যবহার করা হয় তাকে বলে মাত্রা আর এই মাত্রাকেই যখন আমরা আবার আরো ক্ষুদ্র বা ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র ভাবে প্রকাশ করি তখন তারই নাম হয় পদ , এই পদগুলিকে আবার দু ভাগে ভাগ করা যায়, সমপদী আর অসমপদী , যেসব তালে পদ বিভাগ সমান-সমান হয় তাদের বলে সমপদী, এই যেমন দাদরা ... ঠাকুমার মতো ভালো শ্রোতা পেয়ে সঙ্গীতের ব্যাপারে আমার যা জ্ঞান তা যেন আজ উজাড় করে দিতে চাইলাম , কিন্তু ঠাকুমাও এক সময় তার ধৈর্য হারালো, আরে বাবা, থাম দেখিনি, আমি হলাম গিয়ে মুখ্যসুখ্য মানুষ, এতকিছু বুঝি নাকি, তুই বরঞ্চ যাঁরা এসব বোঝে তাদেরকে গিয়ে বোঝা, আমার হতাশ মুখটার দিকে তাকিয়ে ঠাকুমা এবার বলে ওঠে, শোন আমি অত কিছু বুঝি না কিন্তু এটা জানি যে তাল হচ্ছে গিয়ে আসলে একটা ছন্দ, আর এই ছন্দটা শুধু গান বাজনার জগতেই নয় , জীবনের সব ক্ষেত্রেই সমান ভাবে প্রযোজ্য, দেখবি আমাদের জীবনটা ততক্ষণই ঠিকঠাক চলে যতক্ষণ তার ছন্দ বজায় থাকে, আর ছন্দে একবার ছেদ পড়লে মানুষ দেখবি তখন কেমন যেন দিশেহারা হয়ে যায়, আমাদের অবস্থানটা যেন এখন বদলে গেছে, ঠাকুমা এখন বক্তা আর আমি শ্রোতা। রেলগাড়ি কত জোরে ছোটে দেখেছিস, কী ভীষণ তার শব্দ, অথচ অত শব্দের মধ্যেও রেলগাড়ির যাত্রীরা কিন্তু নিশ্চিন্তে ঘুমোয়, কেন জানিস, কারণ রেলগাড়ি যখন ছোটে তখন তার শব্দে একটা ছন্দ মিশে থাকে , আর চলতে চলতে গাড়িটা যখন হঠাৎ ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে যায় তখন দেখবি যাত্রীরা কিন্তু ঘুম ভেঙ্গে উঠে পড়ে।

আচ্ছা ঠাকুমা, তুমি কখনো রেলগাড়ি চড়েছ?

ও মা ! চড়ব না কেন! তোর ঠাকুরদাই তো কতবার চড়িয়েছে, কত জায়গায় ঘুরতে গিয়েছি আমরা রেলগাড়ি চড়ে, পুরো দক্ষিণ ভারত, তারপর উত্তর ভারতের মথুরা , বৃন্দাবন, হরিদ্বার, তোর বাবাও অবশ্যি আমাকে দুবার রেলগাড়ি চড়িয়েছে, ঐ একবার যখন কাজলকে দেখতে গেলাম আর তারপর বেয়াই মশাই যখন মারা গেলেন।

আচ্ছা ঠাকুমা , বৃষ্টিস্নাত এই বিকেলে আমাদের আলোচনার বিষয়টা যেন বারবার তার পথ বদলাচ্ছে, মাকে দেখতে গিয়ে তুমি কি সেদিন মায়ের ইন্টারভিউ নিয়েছিলে?

ধুর ইন্টারভিউ আবার কী, আমি তো শুধু একটাই প্রশ্ন করেছিলাম , বাবাকে ছেড়ে কোলকাতায় গিয়ে থাকতে পারবে তো?

শুনে মা কী বলেছিল ?

তোর মা বলেছিল , বলতে পারব না , কোনোদিন তো বাবাকে ছেড়ে থাকিনি, তাই জানি না।

আর কিছু জিজ্ঞাসা করনি?

না তোর মাকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করিনি তবে তোর দাদুকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করেছিলাম।

কী কথা গো ?

তোর বাপ আর মা যখন আলাদা করে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল তখন বেয়াই মশাইকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম , ছেলে তো আমার বয়সে আপনার মেয়ের থেকে অনেক বড়, তা আপনার মেয়ের এই বিয়েতে আপত্তি নেই তো?

শুনে দাদু কী বললো ?

বেয়াই মশাই বললেন, দেখুন এসব আসলে মনের ব্যাপার, আর আমায় যদি জিজ্ঞাসা করেন তাহলে আমি বলব যে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বয়সের একটু ব্যবধান থাকা ভালো , তাতে সম্পর্কের তাপ উত্তাপ অত সহজে সম্পর্কের ওপর তার প্রভাব বিস্তার করতে পারে না।



বৃষ্টির জন্য সন্ধ্যাটা আজ যেন অন্যান্য দিনের থেকে একটু আগেই নামলো , কাক-ভেজা হয়ে বাবা বাড়ি ফিরলে ঠাকুমা বলে উঠলো, ঈশ, একদম তো ভিজে গিয়েছিস, যা তাড়াতাড়ি করে কলঘরে গিয়ে জামাকাপড়গুলি ছেড়ে গায়ে দু'মগ জল ঢেলে নে, আমি ততক্ষণে তোর জন্য চায়ের জল বসিয়ে দেই ।

বাবা গামছা নিয়ে কলঘরের দিকে যেতে যেতে মায়ের কথা জিজ্ঞাসা করলো, মা, কাজল কি এই বৃষ্টিতেও গানের ক্লাসে গিয়েছে?

ঠাকুমা উত্তর দেওয়ার আগেই আমি দুম করে বলে ফেললাম , জানো বাবা , আজ না অলোককাকু গাড়ি করে এসে মাকে গানের ক্লাসে নিয়ে গিয়েছে।

বাবার মুখটা যেন রাগে থমথম করে উঠলো। ঠাকুমাকে উদ্দেশ্য করে বললো মা তুমি তো অন্তত কাজলকে আজ এই বৃষ্টি বাদলার মধ্যে গানের ক্লাসে যেতে বারণ করতে পারতে !

আরে আমি বারণ করব কী, ও তো নিজেই যেতে চাইছিল না , কিন্তু ওদের গানের ক্লাসে আজ নাকি আবার কার আসবার কথা আছে, তাই মাস্টারমশাই সবাইকে আজ অবশ্য করে যেতে বলেছেন।

যতসব ! এই বৃষ্টিতে পথেঘাটে সব হাঁটু জল হয়ে গিয়েছে আর তার মধ্যে কী না লোক আসছে গান শুনতে … বাবার ভ্রু দুটোর মাঝখানে এখন অনেকগুলি ভাজ ।



ও বিশু, ন’টা বেজে গেলো তো রে, যা না, ছাতাটা নিয়ে গিয়ে একটু বাসস্টপে গিয়ে দাঁড়া না।

বাবার মনের মধ্যে যে গজরানিটা এতক্ষণ ধরে পাঁক খাচ্ছিল সেটা যেন ঠাকুমার কথায় বাইরে বেরনোর সুযোগ পেলো , তুমি কী মনে করো, আমি ছাতা নিয়ে বাসস্টপে গিয়ে দাঁড়ালেই তোমার বৌমা অমনি বাড়ি ফিরে আসবে, সে তার সময় মতই দেখবে বাড়ি ফিরবে ।

বড্ড চিন্তা হচ্ছে রে, নিজেকে উদ্দেশ্য করেই ঠাকুমা যেন কথাগুলি বলতে থাকে , এই বৃষ্টি বাদলার মধ্যে বাস-টাস না পেলে মেয়েটার যে আজ কী দুর্দশা হবে কে জানে।

কোনও দুর্দশা হবে না, বাবা যেন চিৎকার করে ওঠে, তারপর গলাটা একটু নামিয়ে ঠাকুমাকে বলে, অত চিন্তা করো না, যাও, ঘরে গিয়ে টিভি দেখো, একটা কথা জেনে রাখো, তোমার বৌমার জন্য আজকাল চিন্তা করবার অনেক লোক আছে , দেখবে তাদেরই কেউ গাড়ি করে তোমার বৌমাকে ঠিক বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যাবে।

ঠাকুমা যেন বাবার কথায় মিশে থাকা শ্লেষটা বুঝেও না বোঝার ভাণ করে, কী জানি বাবা, ফেরার পথে অলোক যদি গাড়ি ...

কথা শেষ করতে দেয় না বাবা, ঠাকুমাকে উত্তর না দিয়ে এবার আমার দিকে চেয়ে চিৎকার করে ওঠে , তখন থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বড়দের কথা গিলছ কেন , তোমার পড়াশুনা নেই ?



প্রায় পৌনে দশটা নাগাদ বাবার অনুমান সত্য করে অলোককাকুর গাড়িটা এসে দাঁড়ালো আমাদের বাড়ির সামনে , মাকে নামিয়ে কাকু আবার ইঞ্জিনে স্টার্ট দিলেন, বাইরে এখনও প্রচণ্ড বৃষ্টি পড়ছে, রাস্তা পার করে বারান্দার গ্রিল অবধি আসতে আসতেই মা একদম ভিজে গেলো আর বাবাকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চটি খুলতে খুলতে মা বলে উঠলো, এই জানো, আজ কী হয়েছে, সাধারণত মাকে এরকম উচ্ছ্বসিত হতে দেখা যায় না, কিন্তু মায়ের উচ্ছ্বাসটায় একটুও পাত্তা না দিয়ে বাবা গ্রিলের দরজায় তালা লাগাতে লাগাতে গম্ভীর গলায় বলে উঠলো, কাজল, তুমি মনে হয় ভুলে গিয়েছ যে আমরা একটা সমাজে বাস করি আর এই সমাজে বাড়ির বৌয়ের একা-একা বাইরের লোকের সঙ্গে রাত দশটায় বাড়ি ফেরাটা মোটেও শোভনীয় নয় , কথাটা ভবিষ্যতে মনে রাখলে খুশী হবো ।

রাত যত বাড়ছে বৃষ্টিটাও যেন তত জোরে নামছে আজ , ঠাকুমা আর আমি এখন ঠাকুমার ঘরে শুয়ে রয়েছি , বাবাও খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়েছে, মা খায়নি, যতবার ঠাকুমা খাওয়ার কথা বলেছে মায়ের সেই এক কথা, আপনারা খেয়ে শুয়ে পড়ুন, আমার সময় হলে আমি ঠিক খেয়ে নেবো । আমি জানি মা আজ আর খাবে না, এখন একা-একা বারান্দায় চেয়ারে বসে থাকবে যতক্ষণ না বাবা এসে জোর করে ঘরে নিয়ে যায় , কিন্তু বাবা যেরকম ক্ষেপে আছে তাতে কি আজ আর জোর করে মাকে ঘরে নিয়ে যাবে, কে জানে, ও ঠাকুমা, মাকে গিয়ে বলো না আজ রাতে মা তো আমাদের সঙ্গেই শুয়ে পড়তে পারে।

ঠাকুমা আমার মাথার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছিল, আমার কথায় আঙ্গুলগুলো থামিয়ে বলে, দাঁড়া, আর একটু দেখি, তারপর না হয় তোর মাকে ধরে নিয়ে আসব, বুঝিস না কেন, ওদের স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া যদি ওরা নিজেরাই মিটিয়ে নেয় তাহলে তার চাইতে ভালো কিছু আর হয় না।

আচ্ছা ঠাকুমা, একটা কথা বলো তো, মাকে যে আজ বাবা এত বকলো , মা কি সত্যি সত্যিই কোনও অন্যায় করেছে?

এক মুহূর্ত কী যেন ভাবে ঠাকুমা , তারপর একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, কী জানিস বাবু, আমার কী মনে হয়, তোর মা তো একটু অন্য ধরনের মেয়ে তাই বিশু মনে হয় ওকে ঠিক মত বুঝতে পারে না।

মা কী ধরনের মেয়ে গো ?

সে বড় হ, তখন তুই নিজেই বুঝতে পারবি, এখন শুধু এটা জেনে রাখ , তোর মা হচ্ছে গিয়ে খাদনের মধ্যে পড়ে থাকা একটা সত্যিকারের হীরে, বড় পবিত্র মেয়ে , যে যাই বলুক আমি কখনো বিশ্বাস করি না যে কাজল কোনও অন্যায় করতে পারে।

কেন জানি না ঠাকুমাকে জড়িয়ে ধরি আমি, ইশ, বাবাও যদি ঠাকুমার মত করে মাকে বুঝতও তাহলে মাকে আজ আর এখন এভাবে একা একা বারান্দায় বসে কাঁদতে হতো না।



অফিসে যাওয়ার জন্য রোজ ন’টা নাগাদ যেমন করুণাময়ী বাসস্টপে এসে দাঁড়াই তেমনি এসে দাঁড়িয়েছি , হঠাৎ কোথা থেকে একটা চৌদ্দ-পনের বছরের ছেলে এসে সামনে দাঁড়ালো , আপনিই তো কুশলদা, তাই না?

ছেলেটিকে এর আগে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ছে না, মাথা হেলিয়ে জানালাম যে আমিই কুশল কর।

আমাকে হ্যাঁ বলতে দেখে ছেলেটি এবার পকেট থেকে একটা খাম বের করে আমার হাতে দিয়ে বললো শুভ্রা বলে তাদের পাড়ায় যে দিদিটা থাকে সে এই খামটা আমায় দিতে বলেছে আর বলেছে খামের চিঠিটা যেন আমি খুব তাড়াতাড়ি পড়ে দেখি । ছেলেটি যেমন হুট করে এসেছিল তেমনি হুট করেই রাস্তা পার করে চলে গেলো আর ওর চলে যাওয়ার পথ ধরে রাস্তার ওপারে তাকাতে আমার মনে হলো একটা ছায়া যেন আমার দৃষ্টি থেকে নিজেকে আড়াল করতে চট করে পান-সিগারেটের দোকানের পিছনে নিজেকে লুকিয়ে ফেললো।

না, চিঠিটা এখন পড়া যাবে না, বাস এসে গিয়েছে , এই বাসটা মিস করলে অফিস পৌঁছতে দেরী হয়ে যাবে।


এক মিনিট, একটাও প্রশ্নের উত্তর তো দিতে পারলেন না, শেষ প্রশ্নটার অন্তত উত্তর দিয়ে যান, কথাগুলি বলতে বলতে শুভ্রা সেদিন খাট থেকে নীচে নেমে এসেছিল আর আমি কোনও কিছু বুঝে উঠবার আগেই এক হাত দিয়ে আমার বুকের সামনের জামাটা খামচে ধরে আমায় ঠেলে ধরেছিল বন্ধ দরজার পাল্লার সাথে , অন্য হাতে ততক্ষণে ও আমার ঘাড়টাকে পিছন দিক দিয়ে সাপের মতো পেঁচিয়ে আমার মুখটাকে টেনে নামিয়ে নিয়ে এসেছিল ওর মুখের সামনে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সমস্ত ঘটনাগুলি ঘটে যায় আর আমি কিছু বুঝে ওঠবার আগেই শুভ্রার ঠোঁট দুটো নেমে আসে আমার ঠোঁটে, ঐ অবস্থাতেই ও হিসহিসিয়ে বলে ওঠে, আই লাভ ইউ কুশলদা, ডু ইউ লাভ মি ? এক অদ্ভুত ঘোরলাগা দৃষ্টি যেন সেই মুহূর্তে শুভ্রার চোখদুটো ছুঁয়ে ছিল, বেশীক্ষণ আমি তাকিয়ে থাকতে পারিনি সেই দৃষ্টির দিকে , আমার নিজের শরীরের মধ্যেও কেমন যেন একটা উথাল পাথালি শুরু হয়ে গিয়েছিল , সিনেমায় দেখেছি , বইতে পড়েছি, বন্ধু বান্ধবদের আড্ডাতেও অনেক সময় এরকম অনেক প্রেমের আবেগময় মুহূর্তের বর্ণনা শুনেছি, কিন্তু শুভ্রার শরীরের স্পর্শে সেদিন প্রথমবার বুঝেছিলাম যে মা ঠাকুমা ছাড়াও এই পৃথিবীতে মেয়েদের আরো একটা রূপ আছে আর সেই রূপে আমি যেন ক্রমশ নিজের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছিলাম , হালকা শীতে মোড়া নভেম্বরের সন্ধ্যাতেও আমার সারা শরীর জুড়ে যেন উত্তাপের প্রবাহ বইছিল, খুব ইচ্ছে করছিল দু হাতের বেড়াজালে শুভ্রাকে আরো কাছে টেনে নেই, কিন্তু মনের মধ্যে সেই মুহূর্তে কিছু প্রশ্নও এসে জড়ো হয়েছিল, হ্যাঁ এটা সত্যি যে শুভ্রাকে পড়াতে আমার ভালো লাগে, কিন্তু সেই ভালোলাগাটা তো শুধু একজন শিক্ষক আর ছাত্রীর সম্পর্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, আমি তো সে সম্পর্ক অতিক্রম করে কখনো শুভ্রা সম্পর্কে অন্য কিছু ভাবিনি, তাহলে শুভ্রা কেন আমাদের এই শিক্ষক-ছাত্রীর সম্পর্কের বেড়াজাল টপকে নিজেকে আজ আমার এত কাছে নিয়ে এলো … আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে শুভ্রা এক সময় ফিসফিসিয়ে আবার বলে উঠেছিল, কী হলো কুশলদা, বললেন না তো আপনি আমায় ভালোবাসেন কি না?

নিজেকে ওর আগল থেকে মুক্ত করে পকেট থেকে রুমাল বার করে কপালে জমে ওঠা বিন্দু বিন্দু ঘামের কণাগুলি মুছে নিয়েছিলাম এক সময়, ঠোঁটে লেগে থাকা নোনতা স্বাদটায় একবার জিভ বুলিয়ে ভাবছিলাম কী বলি , ও যা চাইছে তার জন্য তো আমি ঠিক প্রস্তুত নই এখন, আর তাছাড়া জীবনে কোনও কিছুই মনে হয় জোয়ার হয়ে আসাটা ঠিক নয়, তাতে হারানোর ভয়টা অনেক বেশী করে থাকে, আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে শুভ্রা এক সময় নিজেই বলে উঠেছিল, ওকে , আই হ্যভ গট মাই আনসার , ভালবাসেন না , সেটা বলবার জন্য আপনাকে আর কষ্ট করে কথা খুঁজতে হবে না, ইউ মে গো নাও।

শুভ্রা, প্লিজ আমায় ভুল বুঝো না ...

এক ধাক্কায় দরজার পাল্লা-দুটো খুলে দেয় শুভ্রা , প্লিজ কুশলদা, আপনি যান, আমায় এখন একটু একা থাকতে দিন …


তিন লাইনের চিঠি, কুশলদা, একটা জরুরী ব্যাপারে আপনার সঙ্গে কথা বলা দরকার , প্লিজ মিট মি এট হাজরা ক্রসিং বাই থ্রি ও ক্লক, আর হ্যাঁ, সেদিনের ঘটনার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, ভয় পাবেন না, আজকের এই দেখা করার অনুরোধটা আমার তরফ থেকে আপনাকে দ্বিতীয়বার প্রপোজ করবার উদ্দেশ্যে নয়।

বাড়ি ফিরে সেদিন অনেক রাত অবধি একা এ কা ছাদে বসেছিলাম , শুভ্রার কথা ভেবে মনটা খারাপ লাগছিল, মেয়েটা হয়তো আমাকে ভুল বুঝলও, কিন্তু কী করবো আমি, আমরা তো আসলে তখন একটা ঝড়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম, বাবার মৃত্যুর কালো ছায়াটা তখনও আমাদের সংসার জুড়ে ছিল কিন্তু তার থেকেও বড় যে সমস্যাটা ছিল সেটা মাকে নিয়ে, বাবার মৃত্যুর পর মা কেমন যেন হয়ে গিয়েছিল, একদম চুপচাপ থাকত, কথা বলতো না, মায়ের এই শোকস্তব্ধ রূপটা আমি ঠিক সহ্য করে উঠতে পারছিলাম না , মায়ের জন্য সত্যিই আমার খুব ভয় লাগছিল, যে মাকে আমি আমার জীবনের অতল দীঘি বলে জেনে এসেছি চিরকাল, যার বুকে মাথা রেখে মন খারাপের দিনে আমার সমস্ত শান্তিকে আমি খুঁজে পেতে চেয়েছি সেই দীঘিতেই যেন সেদিন কালো মেঘের ছায়া নেমে এসেছিল, মা সারাদিন তখন দেওয়ালে টাঙ্গানো বাবার ছবির দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে থাকতো , বুঝতে পারতাম মায়ের মনের মধ্যে একটা প্রচণ্ড টানাপড়েন চলছে , এ টানাপড়েন কারোর বিশ্বাসের সঙ্গে নিজের অস্তিত্বের লড়াই যেন, বিশ্বনাথ কর নিজের স্ত্রীর প্রতি এক মন অবিশ্বাস নিয়ে এ পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছেন, মা কিছুতেই যেন সেটা মেনে নিতে পারছিল না, তার যে অন্য কোনও পুরুষের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই বা কোনদিন ছিল না, ছবির মানুষটিকেই যে সে তার জীবনের এক এবং একমাত্র ঈশ্বর বলে মেনে এসেছে , এই কথাগুলি বাবাকে আর কোনদিন বুঝিয়ে বলবার সুযোগ পাবে না মিসেস কাজল কর … না শুভ্রা, দ্যট ওয়াজ নট দ্য রাইট টাইম … মায়ের পাশে থাকাটাই তখন আমার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান ছিল … যে করেই হোক মাকে আমার আবার গানের জগতে আমি ফিরিয়ে আনতে চাইছিলাম … কারণ আমি জানতাম সঙ্গীতই হচ্ছে মায়ের একমাত্র আশ্রয় যেখানে সে খুঁজে পায় তার মনের শান্তি … সেদিন রাতে ঘুমিয়ে পড়লে অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম , একটা ধু ধু মরুভূমির মধ্য দিয়ে এক যুবক হেঁটে যাচ্ছে … হঠাৎ করে তার পায়ের তলার বালিগুলো যেন সব আলগা হতে শুরু করলো আর যুবকটি কিছু বুঝে ওঠবার আগেই তার শরীরটা ধীরে ধীরে তলিয়ে গেলো চোরাবালির স্রোতে , পা কোমর বুক ছাড়িয়ে বালির পাহাড় যখন যুবকটিকে প্রায় ঢেকে ফেলছে ঠিক তখনই এক তরুণী এসে দাঁড়ালো তার সামনে , অদ্ভুত তার পোশাক , সারা শরীর জুড়ে একটা কালো কাপড়, সেই কাপড়েরই কিছুটা অংশ দিয়ে মেয়েটি তার নাক মুখ ঢেকে রেখেছে, হাওয়ায় তার চুল যেন মাটির সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে উড়ছে ... যুবকটির দিকে তাকিয়ে মেয়েটি হাসতে হাসতে এক সময় বলে উঠলো ... কী কুশলদা, চিনতে পারলেন না ... আমি শুভ্রা … আই অ্যাম রিয়েলি সরি, আপনাকে আজ আমি এই ভাবে একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাচ্ছি ... কিন্তু কী করবো বলুন … আমার তো আর কোনও উপায় ছিল না … আমি তো আমার সমস্ত হৃদয় দিয়ে আপনাকে ভালবাসতে চেয়েছিলাম … কিন্তু আপনি … নিষ্ঠুরের মত আমায় ফিরিয়ে দিলেন …

পরেরদিন শুভ্রা যখন স্কুলে তখন ওর মাকে গিয়ে বলে এসেছিলাম, কাকিমা, কিছু মনে করবেন না , আমি একটা কোচিনে পড়ানোর সুযোগ পেয়েছি , শুভ্রাকে তাই আমার পক্ষে আর পড়ানো সম্ভব হবে না ।


বলো, কেমন আছ?

ভালো থাকলে নিশ্চয়ই আপনাকে এভাবে বিরক্ত করতাম না!

মাঝের ক’বছরে মেয়েটার যেন একটুও পরিবর্তন হয়নি, সেই একই রকম মেজাজ, সেই একই রকম কথাবার্তা, তবে আগের থেকে শুভ্রা এখন অনেক বেশী সুন্দরী হয়েছে, ওর দিকে তাকালে এখন যে কোনও পুরুষের পক্ষেই চোখ ঘুড়িয়ে নেওয়া অসম্ভব , শরীরে যেমন পূর্ণতার ছাপ এসেছে তেমনি চোখেমুখেও ফুটে উঠেছে একটা নজরকারা ব্যক্তিত্ব , রাজস্থানি ঘাগরার সঙ্গে আজ একটা রংবাহারি টপ পরেছে, চোখে হালকা কাজলের ছোঁওয়া, কপালে তেকোনা টিপ, হাতে-কানে অক্সিডাইজড গয়না, খুব সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে, শুভ্রার মুখ থেকে চোখ সরিয়ে বলি , তোমার তো এবার সেকেন্ড ইয়ার, নিশ্চয়ই অংকে অনার্স?

উঃ! দেখা হলেই খালি পড়াশোনা আর পড়াশোনা ! আচ্ছা পড়াশোনা ছাড়া পৃথিবীতে আর কিছু নেই নাকি ! নাকি পড়াশুনা ছাড়া আপনি অন্য কিছুই জানেন না , এনিওয়ে, ফর ইওর ইনফরমেশন , অংক নয়, ইংরেজিতে অনার্স নিয়েছি।

আবার ধাক্কা খেলাম, মেয়েটা সত্যিই যেন একদম আন প্রেডিকটেবল , অংক না নিয়ে ইংরেজিতে অনার্স নিলে , কী ব্যাপার ?

সেই সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলা, আমার অবাক হওয়াটা যেন তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছে শুভ্রা। অবাক হলেন, তাই না? আরে বাবা, অঙ্ক সাবজেক্টটায় কী আছে বলুন তো, ঐ তো সেই স্টিরিও টাইপ কিছু ফর্মুলা আর তা মিলিয়ে মিলিয়ে অংক কষে যাওয়া আর অ্যাট দ্য এন্ড অফ দ্য ডে ফর্মুলায় ভুল না হলে উত্তর মিলে যাওয়া, কিন্তু আমাদের জীবন দেখুন, সেখানে কিন্তু কোনও ফর্মুলা চলে না … আমাকে ওর মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে শুভ্রা এক সময় হেসে ফেলে , আরে বাবা , ঠিক আছে লেট মি টেল ইউ দ্য ট্রুথ , আপনি পড়ানো ছাড়ার পর অন্য কারোর কাছে অংক কষতে আর মন বসছিল না ... বয় এসে খাওয়ারের অর্ডার নিয়ে গেলো , আমরা এখন হাজরা মোড়ের একটা রেস্টুরেন্টে বসে রয়েছি, বাদ দিন ওসব কথা, বলুন , কেমন আছেন ?

শুভ্রাকে জানাই যে ভালোই আছি , বছর কয়েক হলো ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ থেকে যে চাকরিটা পেয়েছি সেটাই মন দিয়ে করে যাচ্ছি , নিজের কথা বলা শেষ হলে ওকে জিজ্ঞাসা করলাম , বললে না তো , হঠাৎ করে এভাবে একেবারে সমন দিয়ে ডেকে আনলে কেন?

কোথাও যাওয়ার তাড়া আছে নাকি আপনার?

না, তাড়া নেই , তবে কথাটা জানতে খুব ইচ্ছে করছে ।

শুধু ইচ্ছেই করছে! না মনে মনে ভয়ও পাচ্ছেন?

ভয় পাবো কেন, তুমি কি বাঘ না ভাল্লুক ?

সেটা তো আপনিই জানেন, সেদিন যেভাবে আমাদের বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিলেন তাতে তো মনে হয় আমি বাঘ বা ভাল্লুক জাতীয়ই কিছু! শুভ্রা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলে যাচ্ছে, ওর বলার মধ্যে কোনও আড়ষ্টতা নেই , বরঞ্চ সেদিনের কথা ভেবে আমারই যেন এখন কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে, শুভ্রা অবশ্য আমার সেই অস্বস্তিটা বেশীক্ষণ স্থায়ী হতে দিলো না , টেবিলের ওপর পড়ে থাকা ওর শৌখিন হ্যান্ড ব্যাগের জিপারটা টেনে তার ভেতর থেকে দুটো ফটো বের করে তার একটা ফটো আমার দিকে এগিয়ে দিলো , সুদর্শন এক তরুণের ফটো , দেখলেই বোঝা যায় যে বেশ পয়সাওয়ালা ঘরের ছেলে, জিজ্ঞাসা করলাম , কে ইনি ?

ইনি হচ্ছেন গিয়ে মিস্টার শঙ্কর চৌধুরী , বাবার বন্ধুর ছেলে, আই আই টি কানপুর থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে সিঙ্গাপুরের একটা কোম্পানি থেকে জব অফার পেয়েছেন , সামনের মাসের পরের মাসে সিঙ্গাপুর চলে যাচ্ছেন সেই অফার নিয়ে, একটানা কথাগুলি বলে শুভ্রা একটু থামে, , কোল্ড-কফিতে একটা চুমুক দিয়ে আবার বলতে শুরু করে, এটা হচ্ছে গিয়ে ফটোর মালিকের সংক্ষিপ্ত বায়ো-ডাটা আর অ্যাডেড ইনফরমেশন হচ্ছে আওয়ার প্যারেন্ট হ্যভ অলরেডি ফিক্সড এ ডেট ফর আওয়ার ম্যারেজ, সামনের মাসের তিন তারিখে আমাদের বিয়ে।

কগ্রাচুলেশন! খুব আন্তরিক ভাবেই শুভ্রার মুখের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলে উঠলাম ।

সত্যি কুশলদা! জীবনে না আপনি অঙ্ক ছাড়া আর কিছুই বুঝলেন না! কী করে ভাবলেন বলুন তো আপনার মুখ থেকে এই কনগ্রাচুলেশনটা শুনবো বলে আপনাকে আজ এভাবে ডেকে পাঠাব বা পাড়ার ছেলেটাকে নিয়ে গিয়ে সেই সকাল থেকে আপনার বাসস্টপে অপেক্ষা করব যে কখন আপনি বাস ধরতে আসবেন , ডু ইউ থিংক, অল দ্যট আই ডিড জাস্ট টু হিয়ার দ্যট ওয়ার্ড, কনগ্রাচুলেশন , শোনবার ভুল হতে পারে কিন্তু কথা বলতে বলতে শুভ্রার গলাটা যেন একটু ধরে আসছে , একটা অবরুদ্ধ কান্না যেন জোর করে ও চেপে রাখতে চাইছে, কিছু বলি না , চুপ করে থাকি , অনেক সময় কথা না বলাই ভালো , নীরবতাও কথার মাঝে কখনো হাইফেন হয়ে অনেক কথা বলে যায় , ব্যাগ থেকে টিস্যু বার করে শুভ্রা চোখের কোন দুটো মুছে নেয় , ইউজড টিস্যুটাকে ভাঁজ করে প্লেটের নিচে রেখে আবার বলতে থাকে , কুশলদা একটা কথা জেনে রাখবেন , জীবন থেকে পালিয়ে গিয়ে কিন্তু জীবনটাকে কখনো উপভোগ করা যায় না, এনিওয়ে বাদ দিন ওসব কথা , শুভ্রা এবার দ্বিতীয় ফটোটা আমার দিকে এগিয়ে দেয়, সেখানেও একটি অল্প বয়স্ক যুবকের ছবি, গীটার হাতে স্টেজের ওপর গান করছে, বেশ লম্বা ছিপছিপে চেহারা, চোখদুটোয় কেমন যেন একটা স্বপ্ন স্বপ্ন ভাব, দিস ইজ সমুদ্র, আমার এক বন্ধুর দাদা, ফোক আর মডার্ন সঙ্গীতের মিশ্রণে ওরা মানে সমুদ্র আর ওর বন্ধুরা গানের একটা নতুন ধারার সৃষ্টি করতে চাইছে, কথাগুলি বলতে বলতে শুভ্রার মুখে আবার সেই উজ্জ্বলতা যেন ফিরে আসছে, ইউ নো কুশলদা , দে হ্যভ অলরেডি গট ভেরি গুড রেসপন্স ফ্রম দ্য ইয়ং জেনারেশন , আর আপনার কাছে এসব বলবার বা আপনাকে আজ এভাবে ডেকে পাঠানোর একটাই কারণ , আই নিড সাম হেল্প ফ্রম ইউ ফর সমুদ্র, প্লিজ না বলবেন না।

আরে বাবা , কীসের হেল্প সেটা তো আগে বলো।

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকে শুভ্রা, নিজেকে যেন একটু গুছিয়ে নেয় , অবশিষ্ট কফিটুকুতে শেষ চুমুক দিয়ে বলতে শুরু করে, বছর দুয়েক আগে একটা বার্থডে পার্টিতে সমুদ্রের সঙ্গে ওর আলাপ হয় আর আলাপের কিছুদিনের মধ্যেই সমুদ্র ওকে প্রপোজ করে , প্রথমদিকে সমুদ্রর ব্যাপারে শুভ্রার সেরকম আগ্রহ না থাকলেও সময়ের সাথে সাথে একদিন নাকি ও বুঝতে পারে যে সমুদ্র সত্যিই ওকে ভালবাসে।

আসলে কী জানেন কুশলদা , সবাই তো আর আপনার মত নয় , এই পৃথিবীতে সমুদ্রর মতও অনেক ছেলে আছে যারা খুব সাধারণ একটা মেয়েকে ভালবাসতে ভয় বা ঘৃণা কোনটাই পায় না।

শুভ্রার কথায় মিশে থাকা শ্লেষটাকে অগ্রাহ্য করি, কিন্তু তোমার মা-বাবা তো অলরেডি শঙ্করের সঙ্গে আই মিন তোমার বাবার বন্ধুর ছেলের সঙ্গে…

সো হোয়াট, বাবা-মায়ের কথা উঠতেই শুভ্রা যেন কেমন উত্তেজিত হয়ে ওঠে, কুশলদা, আই নো হাউ টু ট্যাকল মাই প্যারেন্ট,

দ্যট ওন্টবি এ প্রবলেম ফর মি ।

বুঝতে পারছি না কী বলা উচিৎ , শঙ্করের তো তবু একটা ভাসা ভাসা ইমেজ পেলাম , পড়াশুনায় ব্রিলিয়ান্ট , বিদেশী কোম্পানি থেকে অলরেডি জব অফার পেয়েছে, শুভ্রার বাবা-মা হয়তো তাদের মেয়ের জন্য সঠিক পাত্রই নির্বাচন করেছেন , উলটো দিকে সমুদ্র বলে ছেলেটার কথা শুভ্রা যতটুকু বললো তাতে গানের প্রতি প্যাশন ছাড়া আর কিছুই জানা গেলো না , বুঝতে পারছি না যে শুভ্রার ডিসিশনটা ঠিক হচ্ছে কি না, গলাটা একবার পরিষ্কার করে নিয়ে বললাম , ঠিক আছে , শঙ্কর নয়, তুমি সমুদ্রকেই বিয়ে করতে চাও , সেটা তো বুঝলাম কিন্তু সমুদ্রের ব্যাপারে আমার কাছ থেকে কী সাহায্য চাও সেটা তো বললে না।

আসলে সাহায্যটা আপনার থেকে ঠিক নয়, সেটা দরকার মাসীমার থেকে, প্লিজ মাসীমাকে একটু বলুন যে গান বাজনার জগতে তো ওনার অনেক চেনাশুনা, যদি সমুদ্রকে একটু পরিচয় করিয়ে দেন সেই জগতে।

অনেক চেষ্টা করেও শুভ্রাকে বোঝাতে পারলাম না যে সমুদ্র যে ধরনের গান গায় সেখানে মা মনে হয় বিশেষ কিছু হেল্প করতে পারবে না।

হোয়ার ইজ মিত্রা এন্ড হোয়াই হিজ ফোন ইজ সুইচড অফ, ফোনের অপর প্রান্তে সায়গল সাহেব, সকাল সকাল যেন কামান দাগছেন।

শালা! আমি কী করে জানব যে মিত্র এখন কোথায় বা তার ফোনই বা কেন সুইচড অফ, আমি কি মিত্রের পি এ নাকি, মুখে অবশ্য বললাম, স্যার আমি ঠিক জানি না, সকাল থেকে আমিও তিন-চারবার ফোন করেছি কিন্তু প্রতিবারই ঐ একই রিপ্লাই , দ্য নম্বর ইউ হ্যভ ডায়ালড ইজ কারেন্টলি সুইচড অফ ।

বসকে ছেড়ে সায়গল এবার আমায় নিয়ে পড়লেন, জানতে চাইলেন এক্সিনের কেসটার ব্যাপারে, যাক বাঁচা গেল, এক্সিনের কেসটা একদম স্মুথলি এগোচ্ছে, গলায় তাই আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললাম, স্যার, এভরিথিং ইজ গোয়িং ভেরি স্মুথ, স্পেক ইজ আন্ডার ফাইনাল রিভিউ এবং আমার কাছে যা খবর তাতে আমাদের তিনটে প্রডাক্টই নমিনেটেড মেক হয়ে যাচ্ছে।

বুলশিট! এই জন্যই তোমাদের দ্বারা কিচ্ছু হয় না, অপ্রত্যাশিত আক্রমণে ফোনটা প্রায় আমার হাত থেকে পড়েই যাচ্ছিল, কোনক্রমে নিজেকে সামলে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম কিন্তু তার আগেই জি এম সাহেব আবার কামান দাগতে শুরু করলেন, কুশল, আই মাস্ট সে ইউ পিপল আর রিয়েলি ইউজলেস , অলওয়েজ ইউ আর টেকিং এভরিথিং ভেরি লাইটলি এন্ড নেভার ট্রায়িং টু ফাইন্ড আউট দ্য রিয়েলিটি, টেল মি অনেস্টলি , লাস্ট টাইম হোয়েন ডিড ইউ ভিজিট এক্সিন?

স্যার, তোতলাতে শুরু করি , স্যার মানে , লাস্ট উইকের শুক্রবারে …

এন্ড টুডে ইজ ওয়েডনেসডে, ডোন্ট ইউ থিংক যে এর মধ্যে আরো একবার তোমার এক্সিনে ভিজিট করা উচিৎ ছিল ? ডোন্ট ইউ ফিল, দিস প্রজেক্ট নিডস সাম স্পেশাল অ্যাটেনশন ?

স্যার, আসলে আমি একটা রিপোর্ট নিয়ে দু দিন খুব ব্যস্ত ছিলাম , তাই আর কী ...

হেল উইথ ইওর রিপোর্ট, সিটিং ইন অফিস ইউ পিপল আর ওনলি মেকিং রিপোর্টস, রাইট নাও গো টু এক্সিন এন্ড আস্ক রিচার্ড টু স্পিক টু মি। বুঝলাম এক্সিনের ব্যাপারে বড় কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে, কিন্তু একটা ব্যাপার কিছুতেই বুঝতে পারছি না যে এক্সিনের অফিসে গিয়ে আমায় কেন রিচার্ডকে বলতে হবে যে জি এম সাহেবকে ফোন করুন , সায়গল সাহেব তো নিজেই ফোন করে ওনার সঙ্গে কথা বলে নিতে পারেন, যাক, বেশী বোঝাবুঝি করে কাজ নেই, সায়গলের যা মুড দেখছি তাতে এখন কিছু জিজ্ঞাসা করতে গেলে বহুত ঝাড় খাওয়ার সম্ভাবনা , তার চাইতে এক্সিনের অফিস থেকে একবার ঘুরেই আসা যাক ।



প্রায় দু’ঘণ্টা হলো এক্সিনের রিসেপশনে বসে রয়েছি, রিসেপশনিস্ট ভদ্রমহিলা সেই যে সাড়ে দশটার সময় ভিজিটিং কার্ডটা ফেরত দিয়ে বললেন যে রিচার্ড সাহেব মিটিংয়ে ব্যস্ত , একটু অপেক্ষা করতে হবে, তারপর থেকে পরিস্থিতির কোনও অদল বদল নেই , এক মনে মোবাইলে গেম খেলছিলাম , হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো, বসের ফোন, আরে আপনি কোথায়, জি এম সাহেব তো আপনাকে পাগলের মত খুঁজছেন।

জানি , এই মাত্রই কথা হলো , আরে আর বলো না, কাল রাতে ঘুমচ্ছি, হঠাৎ পাশের ফ্লাটের ভদ্রমহিলা এসে কলিং-বেল বাজালেন, ওনার হাজবেন্ডের ম্যাসিভ হার্ট-অ্যাটাক , সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলোককে নিয়ে হাসপাতালে গেলাম আর সেই থেকে এই বেলা দশটা অবধি হাসপাতালেই ছিলাম, ফোনের ব্যাটারি একদম ডিসচার্জ হয়ে গিয়েছিল , তাই সুইচ অফ করে রেখেছিলাম , এনিওয়ে, তুমি এখন কোথায় ?

দু’ঘণ্টা হলো এক্সিনের রিসেপশনে বসে আছি।

কেসটায় কেলো হয়ে গিয়েছে।

হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হলো, ফোনে সায়গল সাহেবকে খুব আপসেট শোনাচ্ছিল , আমায় তো বহুত ঝাড়লো, বললো আমরা নাকি সব ইউজলেস।

ধুর আমরা কী করব, আসল খেলাটা তো ওনার বন্ধু রিচার্ডই খেলে দিয়েছেন ।

বসের কথায় যেন একটা রহস্যের গন্ধ পেলাম , রিসেপশনের ভদ্রমহিলা যাতে শুনতে না পান এমনভাবে মিত্রকে বললাম, কী বলছেন! রিচার্ড আর সায়গল তো হরিহর আত্মা , তা হঠাৎ করে সেই বন্ধুত্বে ছন্দপতন! ব্যাপারটা কী?

আরে আর বলো না, রিচার্ডটা হচ্ছে গিয়ে একটা রিয়েল খচ্চর, সায়গলকে এতদিন ধরে বলে এসেছেন যে ডোন্ট ওরি, তোমাদের তিনটে প্রডাক্টই নমিনেটেড মেক হয়ে যাবে , ওদিকে কাল সায়গল কোথা থেকে যেন খবর পেয়েছেন, তিনটে নয়, আমাদের শুধু একটা প্রডাক্টই নমিনেটেড মেক হয়ে যাবে, বাকী দুটোয় সিগমা বলে বোম্বের যে পার্টিটা আছে তাদের নাম থাকবে ।



আবার ফোন, এবার উর্মি , হ্যাঁ বলো।

তোমার মায়ের নামে একটা রেজিস্টার্ড চিঠি এসেছে, চিঠিটা কি রিসিভ করব?


ক্রমশ