শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪

কটন কলেজ, পর্ব -৭

,

।।সাত।।

-এই নিরঞ্জন ,উঠ উঠ।

-কটা বাজল?

-সাড়ে চার।

উঠতে চেয়েও আমার উঠার ইচ্ছা করল না। সকাল আটটা পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকা রমেনের ব্যস্ততা দেখে আমার হাসি পেয়ে গেল।হুলুস্থূল করে বেডিং বাঁধতে শুরু করেছে।

আমি ভাবছি আজ যাব কি যাব না।হাতে মাত্র সাত টাকা আছে।এত দূরের রাস্তা,রেলওয়ে কনসেশনটা পেয়েছি বলে কাঁটায় কাঁটায় থার্ড ক্লাসের ভাড়াটা কোনোরকমে হয়ে যাবে।পথে খাবারের জন্য একটি পয়সাও থাকবে না।

আজ কারও কাছ থেকে পয়সা আসবে কি?

না,কোথা থেকে আসবে? কী আশায় বসে থাকব? গুয়াহাটিতে একদিন থাকলেই সব মিলিয়ে তিন টাকা খরচ হবে।মিছামিছি হাতের পয়সা গুলিও শেষ হয়ে যাবে।

কিন্তু এখন যদি এদের সঙ্গে যাই বড় লজ্জায় পড়তে হবে। তারমধ্যে অনেক মেয়েরাও নাকি সঙ্গে যাবে। রমেনের হাতেই দশ বারোটি মেয়ের কনসেশন ফর্ম।নতুন পয়সা গুলি বেরোনোয় খুব ভালো হয়েছে,যেখানেই যাক না কেন,যতদূরই যাক,গোটা টাকায় কোথাও টিকেট পাওয়া যায় না। টাকায় কয়েক নয়া কম হবে,নয়তো কয়েক নয়া বেশি হবে।যদি কারও ভাড়া সাত টাকা আশি নয়া হয় সেও আট টাকাই দিয়েছে,সাতটাকা চল্লিশ নয়া হলেও সেই আট টাকাই দিচ্ছে।নয়া পয়সাগুলি দিতেও অসুবিধা,নিতেও অসুবিধা। তারমধ্যে এতগুলি টিকেট করা হবে যখন এতগুলি নয়া পয়সা সঙ্গে নিয়ে কোথায় ঘুরে বেড়াব?সে কথা রমেন স্পষ্ট করে টিকেট করতে দেওয়া মেয়েদের বলে দিয়েছে। কাল বিকেলের মধ্যে রমেনের হাতে আগের কথামতো ‘কনসেশন ফর্ম এবং পয়সা জমা পড়ে গেছে। রাত নয়টার সময়,মানে চা খাওয়া ভাই’বলার সময় থাকার পরে কাল রাতে সে ঘোষণা করে দিয়েছে যে তার টিকেটটাও সেই পয়সা থেকে করেও আরও তিন টাকা বেঁচে যাবে। সে নিশ্চিত যে এতগুলি মেয়ের কথা যখন কাউকে আলাদা আলাদা ভাবে পয়সা ঘুরিয়ে দেবার সময় হবে না। প্রত্যেকের হয়ে কাউকে গোটা টাকাটা দিয়ে দেওয়ার চেয়ে নাকি তার কাছে রেখে দেওয়াই ভালো।কারণ তার ভাষায়,’অল আর ইন দি সেম বোট ব্রাদার।‘

না,এদের সঙ্গে যাওয়া ঠিক হবে না।একবার ভাত আর দুবার চা অন্তত লাগবেই।না,এদের সঙ্গে না খেয়ে না দেয়ে আমার অবস্থাটা জানিয়ে দেওয়ার চেয়ে রাতের পেসেঞ্জারে গরুর গাড়ি চড়ার মতো করে যাওয়াই ভালো।রেল ভাড়াটা আছে যখন বাড়ি পৌছে যাব।এখানেও যা দেনা ছিল সব দিয়ে দিয়েছে। আজ সারা দিন কোথায় ও চা টাখেয়ে খরচ না করলে সাত টাকা রাত পর্যন্ত থাকবেই।

‘এই এই উঠছিস না কেন?আফিঙখোরের মতো শুয়ে আছিস কেন?’

রমেন আবার দপ করে উঠল।অমর শর্মা ইতিমধ্যে উঠে গেছে।তার বাড়ি ডিগবয়ে। রমেনের বাড়ি যদিও দুলিয়াজানে সে ডিগবয়েরই। এ ও সি থেকে ওয়েল ইণ্ডিয়ায় বাবার বদলি হওয়ার বেশিদিন হয়নি।সে ডিগবয়ে বড় হয়েছে।তারপরের জীবন হোস্টেলে।

‘উঠ উঠ বলছিস,কিন্তু আমি কীভাবে যাব?এক সপ্তাহ আগে বাড়িতে এক্সপ্রেস চিঠি দিয়েছি পঞ্চাশ টাকা টিএমও করার জন্য,আজ পর্যন্ত খবর নেই,এতটুকু কাণ্ডজ্ঞান না থাকলে কীভাবে হবে?’

কথাগুলি ক্রোধ আর বিরক্তি মিশিয়ে বললাম।রাত শেষ না হতেই বিছানাতেই প্রথম ফাঁকি। ক্রোধ আর বিরক্তি আমার দুটোই উঠেছিল সত্যি কথা,কিন্তু ঘরের ওপরে নয়,নিজের ওপরে।এভাবে কত আর ফাঁকি দিয়ে দিয়ে কাটাব।বাড়ির ওপর রাগ করা বা বিরক্ত হওয়ার সাহস আমার নেই।এটা যে দিয়েছে সেটাই যথেষ্ট,আর কত দেবে?

কিন্তু সত্যি কথা বলার সমান মূর্খামি আর নেই।সত্যি কথা বলা মানে কেউ যে আমাকে সাহায্য করবে তা নয়,আমার অবস্থাটাকে কেবল করুণা করবে।

‘আবে এখন এর কথা শোন।কাল যে আট টাকা দেখেছিলাম পুরোটাই এক রাতে উড়িয়ে দিলি নাকী?এই ধরনের গোল্ডেন অপারচুনিটি হারাতে হলে চিরজীবন আফশোষ করবি বাছা।‘

‘সাত টাকায় আমার ভাড়া হবে না রাস্তার খরচ হবে।আজকের দিনটা দেখি টি এম ও আসে নাকি? না হলে রাতের ট্রেনে যাব।‘

‘ড্যাম ইউর ভাড়া।কটন-হ্যাণ্ডিক দুটো হোস্টেলের মেয়েরাই টিকেট করবে।তাছাড়া তোর মতো ইণ্ডিয়ান রেলওয়েজ আর ন্যাশনেল প্রপার্টি এসব কথামুখস্থ বলতে পারা একদল টিকেট করবে,তারপরে আবার তোর আর আমার টিকেটের কিসের প্রয়োজন?

‘না ভাই কোথাও ধরা পড়ে গেলে লজ্জা পেতে হবে।তারমধ্যে এতগুলি মেয়ে সঙ্গে যাবে।‘

‘আরে মেয়েরা সঙ্গে যাবে বলেই তো সুবিধা,আই ক্যান গিভ ইউ দ্য এসুরেন্স মাই বয়,যদি ধরে পথে আমি ভাড়া-ফাইন সব দিয়ে দেব।‘

অবশেষে রমেনের উৎপাতে উঠতে বাধ্য হলাম।ভাগ্যের ওপর ভরসা করে যাওয়াই স্থির করলাম। রমেন যদিও সবসময় পরের মাথায় কাঠাল ভেঙ্গে খায় কিন্তু বিপদের সময় ফেলে দিয়ে পালিয়ে যে যাবে না সেকথা জানি।

আমরা ছয়টা নয় মিনিট বাজতেই স্টেশনে পৌছে গেলাম।এত সকালে যেতে হল বলে রাগ আর বিরক্তি হচ্ছিল,কারণ ট্রেইনের ডিপারচার ৭-৪০ মিনিটে।

‘প্রায় দুই ঘণ্টা আগে স্টেশনে পৌছাতে তোকে কে বলেছিল?’রিক্সা থেকে নেমে আমি কিছুটা বিরক্তির সঙ্গেই বললাম।

‘রিজার্ভেশন করতে হবে না কি?’

রিজার্ভেশন? টিকেটই করা হবে না তো রিজার্ভেশন কীসের?’

‘সেইজন্যই তো রিজার্ভেশন দরকার।’

আমি তার কথার উত্তর দিলাম না।নীরব দর্শকের মতো তার কাণ্ডকারখানা দেখছিলাম।ইতিমধ্যে পুরো প্ল্যাটফর্মটাই ছেলেমেয়েতে ভর্তি হয়ে গিয়েছিল।কটন কলেজের অ্যানুয়েল পরীক্ষা গতকাল শেষ হয়েছে। হ্যান্দিকের শেষ হয়েছে আজ তিনদিন।তবু কটনের ছেলেদের সঙ্গে যাবার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে।এই কয়েকদিন ঘুরে বেড়িয়েছে।যতই মাঝখানে পাকা দেওয়াল রেখে নিজেকে ভালো মেয়ে বলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করুক না কেন,এই সুযোগটা কাজে লাগাতে কেউ দ্বিধা করে না। বাড়িতে খোলাখুলিভাবে বলে দেওয়া যায়,আসার কোনো সঙ্গী নেই,কী করা যাবে?

গাড়ি এসে প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে একটা কামরায় রমেন চক দিয়ে ‘রিজার্ভ ফর কটন কলেজ’কয়েকটা জায়গায় লিখে দিল।প্রত্যেকটি দরজার সামনে বেছে বেছে দুটো করে ছেলেকে দাঁড় করিয়ে দিল।চারটে কামরা।একটা ছেলেদের একটা মেয়েদের—এভাবে কামরাগুলিকে চারভাগে ভাগ করা হল।কটনের ছেলেমেয়েরা ছাড়া আর কেউ উঠতে পারবে না।এন সি সি র স্টিকগুলির এতদিন কোনো ব্যবহার ছিল না,আজ সুন্দর ভাবে কাজে লেগে গেল।

হ্যান্ডিকের মেয়ে হলে অবশ্য কনসিডারেশন আছে।তবু রমেনের হুকুম,রিকোয়েস্ট না করা পর্যন্ত যেন সেই কামরা গুলিতে উঠতে দেওয়া না হয়।মেয়ে দেখলে ছেলেরা মাছির মতো মেয়েদের ঘিরে ধরে বলে মেয়েদের একটা অহঙ্কার আছে।এই অহঙ্কা্র চূর্ণ করার একটা সুযোগ এসেছে যখন ছেড়ে দেবে কেন? সারা বছর লোকাল ছেলেদের সঙ্গে ফষ্টি নষ্টি করতে মনে থাকে না,যাবার সময়েই এদের যত রকম ফ্যাসাদ।’

এটা হল রমেনের আক্ষেপ।সেজন্য প্রায় পনেরো দিন আগেই রমেন আমাকে সাবধান করে দিয়েছে,আপার আসামের মেয়েরা মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলে না হাসার জন্য,কথা বলতে চাইলে ব্যস্ততা দেখানোর জন্য।

আমার সঙ্গে তো মেয়েদের বিশেষ সম্পর্ক নেই,সেজন্য তার কথায় মৌনম সম্মতি লক্ষণম’বলে কাটিয়ে দিলাম।কিন্তু তার কথা একেবারে মিথ্যা নয়,বাড়ি কবে যাব না ট্রেনে যাব,পরীক্ষা কেমন হয়েছে ইত্যাদি খবর নেওয়া মেয়ে এই পনেরো দিনে অনেক পেয়েছি।আমিও সাবধানে তাদের জানিয়ে দিয়েছি যে রমেনের সঙ্গে অনেক মেয়েরা যেতে প্রস্তুত হয়েছে,আমার যাবার কোনো ঠিক নেই,অন্য কোনো জায়গায় বেড়াতে যেতে পারি।অর্থাৎ পরোক্ষভাবে তাদের দেওয়া দায়িত্ব,টিকেট কাটা থেকে শুরু করে অনারেরি বডিগার্ড হয়ে সারাটা রাস্তা যাওয়া থেকে অব্যাহতি নিয়েছি।

রমেন সিলেক্টিভ কিছু মেয়েদের সাবধানে বেছে বেছে আমাদের কামরায় উঠিয়ে নিয়েছে।মেয়েরা একবারে না থাকলে সারা রাস্তাটা নীরস হয়ে যাবে।কিন্তু সবাইকে তো নেওয়া যাবে না,ইচ্ছামতো করা উৎপাতগুলি যাতে কোথাও ফাঁস হয়ে না যায় সেদিকে সাবধান হতে হবে।মেয়েদের কথা বলা তো যায় না,লোকাল মেয়ে গর্ব করে গুয়াহাটির জীবনের কথা সঙ্গের মেয়েদের কাছে বর্ণনা করার সময় রমেনের নামটা যে বেরিয়ে আসবে সে নিশ্চিত,মেয়েদের মুখে মুখে কথা গড়াতে গড়াতে তার বোনের কানে পৌছালে আর রক্ষা নেই,সোজা মা তারপরে বাবা।বিংশ শতাব্দীতেও যে বাড়িগুলি এত ব্যাক ওয়ার্ড হয়ে আছে ,সাধারণ সিগারেট খাওয়া কথাটাকে বিশাল বড় ব্যাপার বলে ভাবে,সেজন্যই রমেন খুব সাবধান।

ট্রেইন চলতে শুরু করেছে।গুয়াহাটির একটা বছর শেষ হয়ে এল।সরকারি হিসেবে এক বছর,কিন্তু দিনের হিসেব করতে গেলে এক বছর হতে অনেক বাকি।পরীক্ষাও ভালো হয়নি,অ্যানুয়েল পরীক্ষা বলে যদি পাশ করিয়ে দেয় বলতে পারি না।

আমি এক কোণে বসে পড়লাম।রুমটা এতক্ষণ হাসি,ঠাট্টা,চিৎকার চেঁচামিচিতে মুখর হয়ে উঠেছে।মেয়েরা দেখছি ছেলেদের থেকে এগিয়ে।ধীরে ধীরে আমরা রুমটাতে মেয়েরা থাকার সঙ্কোচটা কাটিয়ে উঠলাম।

মহম্মদ আলি ইতিমধ্যে তাস বের করে নিয়েছে।একটা বেডিং দাঁড় করিয়ে বসিয়ে তার চারপাশে একদল তাস নিয়ে হুলুস্থূল শুরু করে দিয়েছে।টুয়েন্টি নাইন,ব্রিজ এইসব খেলতে খেলতে বিরক্তি এসে যাচ্ছিল।কেউ একজন ফ্লাস খেলার প্রস্তাব দিল।প্রস্তাবমতো কাজ শুরু হয়ে গেল।আমি নীরব দর্শক,তাস খেলতে জানি না,তার মধ্যে এবার যখন জুয়া শুরু হল তখন কোনো উপায় নেই।কেউ একজন তার মাঝখানে চিৎকার করে উঠল—‘রাস্না এস তাস খেলি।’

‘ধ্যাৎ এসব খেলতে জানি না।

এসো,এদিকে এসো শিখিয়ে দেব।’

জনা তিনেক চিৎকার করে উঠল।রাস্না উঠে গেল।সঙ্গে সঙ্গে রৌশানা,বিজুলি,এবং বাকিদের নাম জানি না,সবাই গিয়ে ঠেলা ধাক্কা দিয়ে জায়গা করে বসে পড়ল।তাস খেলা থেকে চিৎকার চেঁচামিচি বেশি হল।আসল খেলোয়াড়দের উৎসাহ আর ও বেড়ে গেল।বাকিরা কেবল এমনিতেই চিৎকার চেঁচামিচি করছে।

রৌশনারা তাস খেলছিল না।দেখতে দেখতে বিরক্তি লাগছিল বোধহয়,হঠাৎ কী মনে হল সে বলে উঠল—‘তোমাদেরই ভালো ভাই,বিরক্তি থেকে রেহাই পাবার জন্য সিগারেট খেতে পার।মেয়েদেরই মুশকিল,কোনো উপায় নেই,স্টেশনে স্টেশনে চা আর কত খাব।’

‘কেন তোমরাও তো সিগারেট খেতে পার’। রফিক কিছুটা কৌতুক করেই বলল।তার কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নগেন সিগারেটের প্যাকেটটা রৌশনারার সামনে তুলে ধরল।

‘ধ্যাৎ মেয়েরা আবার সিগারেট খায় নাকি?’

‘জানি সবাই খায় না—ধীরেন বলল,‘আজ খেয়ে দেখ কেমন লাগে।’

রমেন তো এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল।নগেনের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে রৌশনারার ঠোঁটের ফাঁকে বসিয়ে দিল।রৌশনারা মুখটা সরিয়ে নিয়েছিল যদিও ঠোঁটের ফাঁক থেকে সিগারেটটা খসে পড়ল না। পঙ্কজ সঙ্গে সঙ্গে দিয়াশলাই কাঠি মেরে সিগারেটটায় আগুন জ্বালিয়ে দিল।সিগারেট জ্বালানোর অভ্যাস নেই,কাঠিটা নিভে গেল,সিগারেট জ্বলল না।

‘দূর,এভাবে হবে না’বলে রমেন বিজলিকে ঠেলা মেরে রৌশনারা আর তার মধ্যে বসে পড়ল।সে বসেই তার ডান হাতটা রৌশনারার পিঠের ওপর দিয়ে নিয়ে গলাটা তার দিকে কিছুটা হেলিয়ে হাতটা সামনের দিকে নিয়ে গেল।বাঁ হাতে দিয়াশলাইটা পঙ্কজের হাত থেকে এনে ডান হাতে কাঠিটা নিয়ে পুনরায় সিগারেটটা জ্বালাবার চেষ্টা করল।এবার ও জ্বলল না।

‘দূর এসব খেতে পারব না’বলে রৌশনারা বাঁ হাতে সিগারেটটা এনে রমেনের ঠোঁট দুটির ফাঁকে ঢুকিয়ে দিল। রমেন বাঁ হাতে রৌশনারার মাথাটা তার বুকের দিকে ঠেলে দিয়ে পুনরায় একটা কাঠি জ্বালিয়ে সিগারেট জ্বালাল।

এবার সে দুটান দিয়ে বাঁ হাতে আগের মতোই রৌশনারার গলাটা টিপে ধরে বা হাত দিয়ে সিগারেটটা নিয়ে রৌশনারার ঠোঁটে লাগিয়ে দিয়ে বলল –‘ভেতরের দিকে জোরে জোরে টান।’

রৌশনারা একটু জোরে সিগারেটে টান দিতেই ধোঁয়া গলার ভেতরে চলে যাওয়ায় কেশে উঠল।চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে গেল।তবু সে স্ফুর্তিতে আরও একবার টেনে নিল।

‘খাবি নাকি রাস্না? আজ সুযোগ পেয়েছিস,খেয়ে দেখ’—বা হাতের রুমাল দিয়ে চোখের জল মুছে ডানহাতে সিগারেটটা ধরে রৌশনারা বলল।

‘দে তো দেখি’—বলে রাস্না সিগারেটটা নিয়ে এক টান মেরে দেখল।তার ও একই অবস্থা হল।তার হাত থেকে বিজুলি নিল।এভাবে প্রতিটি মেয়েই সিগারেটে এক টান মারতে মারতে খেতে না জানার দোষে সিগারেটটা ভিজে একশা হল।

একেবারে এই প্রান্তে বসা পূরবী খায়নি।রৌশনারারা দেখল একে যদি খাওয়ানো না যায় ভবিষ্যতে আশঙ্কা থেকে যাবে।হোস্টেলে ভয় নেই,লোকাল মেয়েদের মাধ্যমে বাড়ির লোকের কানে গেলেই মুশকিল হয়ে যাবে।তাই কয়েকবার সবাই মিলে পূরবীকে খাওয়ার জন্য অনুরোধ করল। পূরবী খাবে না,ভয় হয় যদি মাথা ঘোরায়।অবশেষে রাস্না পূরবীকে চেপে ধরল এবং রৌশনারা ঠোঁট দুটির মধ্যে সিগারেট ঢুকিয়ে দিল।সঙ্গে সঙ্গে তাদের মধ্যে টানা হেঁচড়া শুরু হল। পূরবীর শরীর থেকে টেরিলিনের চাদরটা খসে পড়ল।সামনে বসে থাকা রাজীব অন্যমনস্কভাবে চাদরের আগাটা টেনে ধরল।পূরবীও খেয়াল না করে রাস্নাকে ঠেলে দিয়ে উঠতে যেতেই রাজীবের পায়ে চাদরটা লেগে খুলে গেল।তাকে বসিয়ে দেবার জন্য বিজুলি পেছন থেকে চেপে ধরায় পূরবীর ব্লাউজের বোতামগুলি তার হাতে লেগে খুলে গেল। রেলের ঝাঁকুনিতে শরীরের তাল সামলাতে না পেরে দুজন ছিটকে গিয়ে পূরবী পঙ্কজের কোলে এবং বিজুলি রমেনের কোলে গিয়ে পড়ল।পড়ে যাবার ভয়ে দুজনেই আবশ্যকের চেয়ে বেশি জোরে জড়িয়ে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে কামরায় হুলুস্থূল লেগে গেল।দুজনেরই গাল দুটি লজ্জায় সিঁদূর বর্ণ ধারণ করল।দুজনেই অসভ্যগুলি বলে গালি দিতে দিতে উঠে দাঁড়িয়ে কাপড়-চোপড় ঠিক করে নিল।তার আগেই পূরবী পঙ্কজের কোলে বসেই দ্রুত বুকের বোতামগুলি লাগিয়ে নিয়েছিল।

সিনেমা দেখার মতোই এসব ঘটনা দেখতে দেখতে চলেছি।সময় কীভাবে পার হয়ে যাচ্ছে বলতেই পারি না।মাঝে মাঝে চা-এর পর্বচলছে। লামডিঙে সবাই মিলে ভাত খেয়েছি।বাকি কামরাগুলির ছেলেমেয়েদের সঙ্গে অদল-বদল করে যাচ্ছি।কামরাটার ফাগুনে বাতাসের সঙ্গে মনটাকে ইচ্ছামতো নাচতে ছেড়ে দিয়ে যখন ফরকাটিং স্টেশন পার হচ্ছিলাম আমার মন সাগরের সমস্ত ঢেউ জমাট বেঁধে বরফ হয়ে গেল।ভয়,শঙ্কা আর লজ্জায় আমার মন কেঁপে উঠেছিল।

ফরকাটিং স্টেশনে একজন টি-টি-ই আমাদের কামরায় উঠে এল।চেহারা দেখেই ভয় লেগে গেল। বুঝতে পারলাম লোকটার কাছে কোনোরকম জারি-জুরি খাটবে না। কটন কলেজের ছেলেমেয়েদের পথে-ঘাটে টিকেট চেক করাটা খুব বিরল ঘটনা। তার মধ্যে এত দূর ‘রিজার্ভ ফর কটন কলেজ’বলে অর্জুনের অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়ার মতো আসার পরে একজন সাহস করে উঠেছে যখন সে বভ্রূবাহন না হলেও সে ধরনেরই কেউ হবে।

কী আশ্চর্য,আমি এত ভয় পেয়েছি যদিও বাকিদের কারও মুখে কোনো পরিবর্তন দেখলাম না। রমেনের টিকেট নেই,রাজীবের নেই,মহম্মদ আলির নেই কিন্তু ওরা নির্বিকার। একের পর এক সিগারেট খাচ্ছে,আগের মতোই হইচই করছে।আমরা ছেলেরা দরজার সামনে বসেছিলাম।মেয়েরা একেবারে শেষপ্রান্তে ছিল। রমেন একবার মাত্র রাস্নাকে বলল—আমাদের টিকেটগুলি দাও তো।কী আশ্চর্য তার কথামতোই সঙ্গের তিনজনের টিকেটগুলির সঙ্গে চারটে টিকেট রাস্না বের করে দিল।আমি ভেবে কোনো হদিশ পেলেম না এখন তারা কী করবে,আমরাতো চলে যাব কিন্তু ওরা এখন কী করবে?

এক্সপ্রেস ট্রেন।সব স্টেশনে থামে না।রমেনরা টি-টি-ই এর সঙ্গে কথা বলছে।টিকেট বের করে দেখাতে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সময় নিচ্ছে।টি-টি-ই ব্যাপারটাতে খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না। এর পরে একেবারে মরিয়নি স্টেশনে গিয়ে ট্রেন থামবে।তাই তাড়াহুড়ো করার খুব একটা দরকার নেই।মরিয়নি পৌছানোর আগে টিকেট চেক করার কাজ শেষ হয়ে যাবে।

মেয়েদের জন্য আমার মনটা ছটফট করতে লাগল।তারা এখন কি করবে!তাকিয়ে দেখি রাস্না দ্রুত কাগজের টুকরোয় কী যেন লিখছে।রৌশনারা বাস্কেট থেকে সুতো বের করেছে।রাস্নার লেখা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাগজটা রৌশনারা সুতোর সঙ্গে বেঁধে জানালার পাশের মেয়েটিকে দিয়েছে।সে টি-টি-ই এর অজান্তে কাগজটা বাইরে বের করে দিয়ে সুতোর অন্য প্রান্তে ধরে ঘুড়ি উড়ানোর মতো উড়িয়ে দিয়েছে।বাতাস কাগজটাকে নিচে পড়তে না দিয়ে ভাসিয়ে রেখেছে।উড়তে উড়তে কাগজটা পাশের কামরায় পৌছে গেল।

আমি ওদের নতুন খেলাটা দেখে অবাক হয়ে গেলাম।সেইজন্য আমার অনুসন্ধিৎসু মনটা নিয়ে ওদের কাণ্ডকারখানা দেখছিলাম। আগন্তুক বিপদের খবর নেই,এখন ছোট মেয়েদের মতো ঘুড়ি উড়ানোয় মেতে উঠেছে।

হঠাৎ বাইরের দিকে মাথা বের করে দেখি যে পাশের কামরার কেউ একজন কাগজটা সুতোর সঙ্গে ভেতরে টেনে নিয়েছে।কিছুক্ষণ পরেই দেখি একটা কাগজের পুঁটলি সুতোর সঙ্গে বেঁধে দিয়ে কেউ একজন ছেঁড়ে দিয়েছে এবং অন্য একজন সঙ্গে সঙ্গে সুতোর সঙ্গে কাগজটা টেনে নিয়েছে।কাগজের পুঁটলিটা এসে মেয়েটির হাতে পড়তে দেখে আমি হতবাক।সেই পুঁটলিটা আর কিছু নয়,কনসেশন ফর্মের সঙ্গে বাঁধা চারটি টিকেট।

এতক্ষণ ধরে মেয়েগুলির উচ্ছৃঙ্খল কাজকর্ম দেখে আমোদের সঙ্গে বিতৃষ্ণা জন্মেছিল যদিও,এবার কিন্তু ওদের বুদ্ধি আর সাহস দেখে মাথাটা আপনা থেকেই নিচু হয়ে এল।নিজেকে ওদের কাছে অনেক ছোট বলে মনে হল।এই মেয়েগুলির জন্যই এই যাত্রা রক্ষা পেয়ে গেলাম।এদের নির্দোষ হাসি তামাসা আমার রক্ষণশীল মনটাকে সাময়িক ভাবে আঘাত দিলেও গোটা বিষয়টাকে আবার নতুন করে ভাবতে ইচ্ছা হল।

এভাবেই চলতে চলতে আমরা এক সময় নেমে পড়লাম।কয়েকজন আমার আগেই নেমে গিয়েছিল।কিছু আমার সঙ্গে নামল।কয়েকজন হাত নেড়ে নেড়ে বিদায় জানিয়ে চলে গেল।

বড় ক্লান্ত মনে হতে লাগল। হঠাৎ এতক্ষণ পরে আমার চোখের সামনে বাড়ির ছবিটা ভেসে উঠল।বাড়ি পৌছানোর সঙ্গে সঙ্গে হয়তো মা জিজ্ঞেস করবে,পথে কোনো অসুবিধা হয়েছে কি?

আমি কী উত্তর দেব ভাবতে পারলাম না।