শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪

ওরা রোহিঙ্গা হিন্দু, ওরা ফিরে যেতে চান মায়ানমারে,



ভুটান মানে স্বপ্নের দেশ- সাংগ্রী-লা। পুজোয় বেড়াতে যাওয়া, ট্রেকিং বা ক্লাইমবিং-এর প্ল্যান করা। ভুটান মানে বৌদ্ধ মঠ, তিব্বতের স্বাদ। ভুটান মানে পৃথিবীর সবচাইতে সুখী দেশ (No. 1 in Happiness Index)। ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু ভুটানের প্রতিবেশী রাজ্য পশ্চিম বাংলার বেশীরভাগ মানুষ জানেন না যে ভুটানের প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষ নেপালি ভাষী হিন্দু। আরও জানেন না যে ১৯৯০ সালে ভুটান তার জনসংখ্যার ২০ শতাংশকে (যারা নেপালি ভাষী ও হিন্দু) বিতাড়িত করে। সুদূর ভিয়েতনাম, কিউবা, প্যালেস্টাইন নিয়ে চিন্তিত রাজনৈতিক সচেতন পশ্চিম বাংলায়, প্রতিবেশী রাষ্ট্রে এতবড় এথনিক ক্লিনজিং ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় কেউ কখনও বিচলিত হয়েছেন বলে জানা নেই। কলকাতার কোনও পত্রিকায় এক কলম রিপোর্ট ছাপা হয়নি, কোনও প্রতিষ্ঠান বিরোধী কবি বা লেখক কলমের এক বিন্দু কালি নষ্ট করেননি। প্রতিবেশী দেশের এই নিপীড়িত মানুষগুলি ধর্মে হিন্দু। তবু কোনও হিন্দুত্ববাদী সংগঠন, গেরুয়াধারী মিশন বা সেবাশ্রম এদের সহায়তায় এগিয়ে আসেননি।

প্রায় কুড়ি বছর পূর্বে নেপালের রিফিউজি ক্যাম্পে অমানবিক জীবন যাপনের পর রাষ্ট্রসংঘের প্রচেষ্টায় এক লক্ষ উদ্বাস্তুর পুনর্বাসনে এগিয়ে আসে ‘সাম্রাজ্যবাদী’, ‘পুজিপতি’ আমেরিকা, ২০১০ সাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত আমেরিকা আশ্রয় দিয়েছে পচাত্তর হাজার নেপালি ভাষী ভুটানী উদ্বাস্তুকে। অন্যান্য শ্বেতকায় পুজিবাদী দেশ আশ্রয় দিয়েছে আরও প্রায় পনের হাজারকে।

পাঠক অবাক হবেন। এ যে ধান ভানতে শিবের গীত। শিরোনামে রোহিঙ্গা আর লিখে চলেছেন ভুটান নিয়ে!

কারণ আছে। সেটা হল যে পশ্চিমবঙ্গবাসী যেমন জানেন না ভুটানের আসল ছবিটা, ঠিক একইভাবে জানেন না রোহিঙ্গা সমস্যার কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক। ভুটান মানে তাদের কাছে সুখের দেশ, বৌদ্ধদের দেশ। তেমনি তাদের কাছে রোহিঙ্গা মানে মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশে প্রায় বাংলা ভাষী মুসলমান, যারা মায়ানমারের বৌদ্ধ উগ্রবাদী ও সেনাবাহিনীর অত্যাচারে পালিয়ে এসেছে বাংলাদেশে। পশ্চিমবঙ্গবাসী যেমন জানেন না ভুটানের হিন্দুদের কথা, তাদের ওপর অত্যাচারের কথা তেমনি জানেন না রোহিঙ্গা মানে শুধু মুসলমান নয়, হিন্দু রোহিঙ্গাও রয়েছে, রোহিঙ্গা হিন্দুরা অত্যাচারিত হয়েছেন তাদের প্রতিবেশী রোহিঙ্গা মুসলমানদের দ্বারা। বাংলাদেশের হিন্দুদের মতন। তাদের একটাই অপরাধ, তারা হিন্দু।

বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েও নিশ্চিন্ত নন হিন্দু রোহিঙ্গারা। রিফিউজি ক্যাম্পে হিংসার বলি হয়েছেন দুই জন, আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আট জন। তাই হিন্দুদের জন্য বানানো হয়েছে আলাদা ক্যাম্প। সেই ক্যাম্পে চব্বিশ ঘণ্টা পুলিশ পাহারা, যাতে রোহিঙ্গা মুসলিমরা সেখানে প্রবেশ করতে না পারে। হিন্দু শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থাও আলাদা, যাতে তাদের জবরদস্তি কলমা পড়ানো না হয়।

এই ছবিটা আরও পরিষ্কার করছে গত ৬ই জানুয়ারি, ২০১৯ লস এঞ্জেলস টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে। রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা সমস্যার ধরণটা নতুন নয়। কাশ্মীর, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, চেচনিয়া, সিনকিয়াং (উঘুর) প্রায় এক চিত্র। সারা পৃথিবীতেই কোনও অমুসলিম দেশেই মুসলিম অধ্যুসিত অঞ্চল থাকলে সেই অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র উপদ্রব অবসম্ভাবী। উগ্রবাদী ইসলাম ও পেত্র-ডলারের মিলন এই উপদ্রবের প্রধান ইন্ধন। অমুসলিম দেশের ধর্ম সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সহ অবস্থান এদের চিন্তার জগত থেকে উধাও অনেকদিন। এই সব মুসলিম অধ্যুসিত অঞ্চলে বসবাসকারী অমুসলিমরা বেঁচে থাকেন দয়ার পাত্র (জিম্মি) হয়ে। লাগাতার চাপ থাকে ধর্মান্তরিত হওয়ার। সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন মেয়েরা।

রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা মুসলিম ও স্থানীয় বৌদ্ধদের মধ্যে অবিশ্বাস, মন কসাকসি ও ছোটখাট ঝুটঝামেলা চলছিল অনেকদিন ধরেই। পরিস্থিতি ঘোরালো রূপ নেয় ২০১৭’র আগস্ট মাসে। রোহিঙ্গা মুসলিমদের সশস্ত্র বাহিনী ‘আরাকন রোহিঙ্গা সলভেশন আর্মি’ (AARSA) আক্রমণ চালায় পুলিশের ওপর। নিহত হন ১২জন অফিসার। এই আক্রমণ শুধু পুলিশের ওপর সীমাবদ্ধ থাকেনি। AARSA একই সঙ্গে আক্রমণ চালায় হিন্দু গ্রাম ফকিরাবাদে। গ্রাম লুঠ করে গ্রামাসীদের চোখ বেঁধে গ্রামের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং হত্যা করা হয় ৫৩জনকে। নিকটবর্তী একটি হিন্দু গ্রামেও (ইয়ে বউক কিয়ার) একই রকম ঘটনা ঘটে এবং হত্যা করা হয় ৪৩জনকে। এমেনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর রিপোর্টে হিন্দু রোহিঙ্গাদের ওপর রোহিঙ্গা মুসলিম সন্ত্রাসবাদী সংগঠন AARSA’র নিয়মিত অত্যাচারের কথা উল্লেখ আছে।

পুলিশ অফিসারদের হত্যার পরে সক্রিয় হয় মায়ানমার সেনাবাহিনী। প্রতি আক্রমণ শুরু হয় AARSA’র ওপর। স্বাভাবিকভাবে এই প্রতি আক্রমণের ধাক্কা এসে পড়ে AARSA সমর্থক ও AARSA’র প্রতি সহানুভূতি সম্পন্ন রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর। বিধ্বস্থ হয় গ্রামের পর গ্রাম। প্রায় আট লক্ষ মানুষ পলায়ন করেন বাংলাদেশে।

এই পলায়নে হিন্দু রোহিঙ্গাদের যোগ দেওয়ার কোনও কারণ ছিল না। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতন মায়ানমারেও সংখ্যালঘু হিন্দুদের সঙ্গে স্থানীয় সংখ্যাগুরু বৌদ্ধদের কোনও সংঘাত নেই। তবু তাদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও যুক্ত হতে হয় পলায়নে। অনেক সময় প্রতিবেশী রোহিঙ্গা মুসলিম বাধ্য করে পলায়নে যোগ দিতে। এই পলায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে রোহিঙ্গা মুসলিমরা হেনস্থা করে হিন্দুদের। ধর্মান্তকরণের চেষ্টা চলে, মহিলাদের বোরখা বা হিজাব পড়তে বাধ্য করা হয়, এমনকি ধর্ষণের শিকার হন কেউ কেউ।

বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েও নিশ্চিন্ত নন হিন্দু রোহিঙ্গারা। রিফিউজি ক্যাম্পে হিংসার বলি হয়েছেন দুই জন, আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আট জন। তাই হিন্দুদের জন্য বানানো হয়েছে আলাদা ক্যাম্প। সেই ক্যাম্পে চব্বিশ ঘণ্টা পুলিশ পাহারা, যাতে রোহিঙ্গা মুসলিমরা সেখানে প্রবেশ করতে না পারে। হিন্দু শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থাও আলাদা, যাতে তাদের জবরদস্তি কলমা পড়ানো না হয়। এরা সাংবাদিকদেরও ঠিক বিশ্বাস করেন না, এড়িয়ে চলেন। কারণ, এরা মনে করেন এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী রোহিঙ্গা মুসলিমদের সন্ত্রাসী বাহিনী ARSA’র হিংস্র কার্যকলাপ।

লস এঞ্জেলস টাইমস-এর প্রতিবেদনে হিন্দু ক্যাম্পের নেতা শিশু শীল বলেন, ‘‘এভাবে বেঁচে থাকা এক দুঃস্বপ্ন। আমরা ভয়ে ভয়ে দিন কাটাই। কারণ, আমরা মায়ানমার সরকারকে হিংসার জন্য দায়ী করি না।’’

গত মে মাসে (২০১৮) রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে রাষ্ট্রসংঘের সাথে মায়ানমার সরকারের একটি চুক্তি হয়। রোহিঙ্গা মুসলিমরা এই চুক্তিটি সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করে। কারণ, এতে তাদের প্রধান দাবি মায়ানমারের নাগরিকত্ব প্রদান স্বীকার করা হয়নি। এছাড়া আরও অন্যান্য সমস্যাও আছে। অপরদিকে হিন্দু রোহিঙ্গারা এই চুক্তিতে কোনও আপত্তি না জানিয়ে যত শীঘ্র দেশে ফেরার জন্য রাজি। সংখ্যাগুরু মুসলিমদের আপত্তির কারণে চুক্তি কার্যকর করা হচ্ছে না। অতঃপর হিন্দু রোহিঙ্গাদেরও দেশে ফেরা বন্ধ। পাঁচ সন্তানের মা পঞ্চাশ বর্ষিয়া জ্যোৎস্না পাল বলেন, ‘‘আমাদের বলা হয়েছিল ১১ই নভেম্বর থেকে দেশে পাঠানোর কাজ শুরু হবে। সেই দিন থেকে আমরা জিনিসপত্র গুছিয়ে তৈরি।’’