শুক্রবার, এপ্রিল ১৯, ২০২৪

একটি অভিশপ্ত দ্বীপভূমি, সেখানে থাকে এক জার্মান সাদা ভূত ...

অবশেষে এসে গেল আমেরিকা ও ভারত সরকারর প্রাথমিক অনুমতি। ওরা দ্বিধায় ছিল, আদৌ এই অনুমতি মিলবে কিনা? কিন্তু সময়মতোই এসে গেল তা। উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে সবাই।ওরা স্থির করেছিল প্রাথমিক অনুমতিটা এলেই হেড স্যারকে খবরটা দিয়ে অবাক করে দেবে। পরদিনই স্কুল শুরু হওয়ার আগে আগে সবাই মিলে হাজির হয় হেডস্যারের রুমে। হেডস্যার ওদের দেখে গম্ভীর হয়ে জিগ্যেস করেন, ‘কি ব্যাপার, আমার আদরের এই বুকের পাটা থাকা পাঁচ ক্ষুদে-দাপুটের চৌখশ মাথায় আবার কী ঝোঁক চাপল?’ বুলটির আর তর সয় না,সে বলে ওঠে , ‘স্যার আমরা অভিযানে যাব ।’ স্যার আঁতকে বলে ওঠেন, ‘অভিযানে যাবি,কোথায়!’ শিম্মি মুখ খোলে, ‘একটি দ্বীপে’। স্যার চোখ দুটো গোল্লা করে শুধোন, ‘কোন দ্বীপে?’এবার বিট্টুস জবাব দেয়, ‘ভোলকানো আয়ল্যান্ড স্যার অর্থাৎ আগ্নেয়গিরি দ্বীপ।’ ‘সেটা কোথায়?’ স্যারের গলায় টান-টান কৌতূহল। বুলটি গম্ভীর ভাবে জবাব দেয় , ‘উত্তর আমেরিকায়’। ‘আরে সাংঘাতিক, একেবারে আমেরিকায়,মনে হচ্ছে তোর বাড়ির কাছেই...!আচ্ছা আমায় বলত, তোরা কেন এই দ্বীপটিকে অভিযানের জন্য বেছে নিলি? এই দ্বীপটির নাম আমি আগে তো শুনিনি...’!

বুলটি জবাবে বলে, ‘স্যার, বোধ হয় জানেন না, আমার বাবার বাবা তাঁর বাবা এবং তাঁর বাবা ছিলেন একজন ভূ-পর্যটক।রামনারায়ণ বিদ্যালঙ্কার।। তাঁর হাতে আঁকা অনেক মানচিত্র ছিল এক সময়,বাবা বলেছেন।কিছুদিন আগে বাবার বাবা অর্থাৎ ঠাকুদ্দা সীতানাথ বিদ্যালঙ্কারের রেখে যাওয়া একটি পুরানো বাক্স ঘাঁটতে ঘাঁটতে পেয়ে যাই সীতানাথের ঠাকুদ্দা অর্থাৎ রামনারায়ণের হাতে আঁকা একটি ধূসর মানচিত্র ।ওই মানচিত্রেই খোঁজ পাই এই দ্বীপের’ । হেডস্যার হাসতে হাসতে বলে ওঠেন , ‘আর সঙ্গে সঙ্গে ঠিক করে ফেললি ওই দ্বীপ অভিযানের, তোরা ডানপিটে জানতাম কিন্তু এতো ডানপিটে...’! স্যারের কথা শেষ করতে দেয় না বুলটি, ‘আরও জানতে পারি স্যার, ওখানে নাকি একটা জীবন্ত আগ্নেয়গিরি রয়েছে,যদিও বর্তমানে ঘুমিয়ে, তবে যখন-তখন জেগে উঠতে পারে। যারজন্য ওখানে লোকজন থাকে না।দ্বীপটাও নাকি ভারী সুন্দর...। ওইসব কারণেই আমাদের উৎসাহটা বেশি বেড়ে গেল স্যার।কারণ অভিযানটা বেশ থ্রিলিং(গায়ে কাঁটা দেওয়া) হবে...।বিপদসংকুলও। ওই দ্বীপে কোনও মানুষ যেতে পারে না বিশেষ অনুমতি ও বিশেষ মানুষজন ছাড়া...’।

হেডস্যার উদগ্রীব হয়ে বলে ওঠেন, ‘তোরা কি ভাবে যাবি তবে, বিশেষ অনুমতি কে দেবে তোদের?’

--অন্যভাবে স্যার, ওটা আমরা ছাড়া কেউ জানেনা স্যার, আপনাকে পরে বলব স্যার। আমাদের শুধু আমেরিকা যাওয়ার অনুমতিটাই প্রয়োজন। আমরা তাই আর সময় নষ্ট না করে যাওয়ার প্রাথমিক পারমিশানটা নিয়ে রেখেছি স্যার...। ওখানে পৌঁছে যাওয়ার পর দ্বীপে যাওয়ার ব্যাপারটা অন্য একজন দেখবে...’।ভোম্বল বলে।

---তোদের কথাবার্তা শুনে তো মনে হচ্ছে তোরা হাতে বিপদ নিয়ে যাচ্ছিস’! হেডস্যারের গলায় উদবিগ্নতা।

ডাব্বু বলে ওঠে, ‘ওই একটু রিস্ক(ঝুঁকি) নিতেই হবে স্যার, নয়তো এডভেঞ্চারের(অভিযানের) কোনও মানেই হয় না স্যার...’।

---ওরে নবীন ওরে আমার কাঁচা/পুচ্ছটি তোর উচ্চে তুলে নাচা’, তোদের বুকের পাঁটা আছে বলতে হবে,তোদের জন্য আমার গর্ব হয়...’। হেডস্যার চেয়ার ছেড়ে উঠে বুলটিদের সবার পিঠ চাপড়ে উৎসাহ দিলেন । বুলটিরাও একে একে সবাই স্যারের পা ছুঁয়ে প্রণাম করল। তারপর বুলটি নম্র সুরে বলে উঠল, ‘এখন শুধু স্যার প্রয়োজন পাসপোর্ট-ভিসা আর টাকাপয়সার...’। হেডস্যার বুলটির কথাটিকে শেষ করতে দেন না। ওর কাঁধে হাত রেখে আশ্বাসের সুরে বলে ওঠেন, ‘তোরা একদম চিন্তা করিস না বুলটি, ওগুলোর দায়িত্ব আমার ওপর ছেড়ে দে, তোরা শুধু এখন প্রস্তুতির দিকে মন দে ...আরেকটা কাজ করবি তোরা, আজ স্কুল ছুটির পর আমার গবেষণাগারে চলে আসিস... এখন তোরা ক্লাশে যা...’। বলতে বলতে তিনি চলে যান বিদ্যালয়ের গবেষণাগারের দিকে। হেডস্যারের মন পেয়ে যেন ওরা একটা যুদ্ধ জয় করার প্রশান্তি পেল।

এর পরের দিন থেকেই হেডস্যার পাঁচ ক্ষুদে দাপুটে-পড়ুয়াকে নিয়ে তাঁর নিজের বাড়িতে ভূ-বিজ্ঞানের আসর বসান কখনো কখনো।সমুদ্র-বিজ্ঞান,পরিবেশ–বিজ্ঞান, ভূতত্ব, বিভিন্ন দেশের মানুষের চরিত্র, স্বভাব, ভাষা ও বর্ণ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।শেখান ইংরেজিতে কথা বলতে। নিয়ে যান সাইন্স ক্লাবে। সবখানেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে আগ্নেয়গিরি নামে ওই জনশূন্য দ্বীপটি ।এ-কদিনের আলোচনা-গবেষণায় ওরা আরও জেনেছে যে, আসলে আগ্নেয়গিরিটাই নাকি একটি দ্বীপ, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় একটি সক্রিয় আগ্নেয়গিরির দ্বীপ, কখন ওটা জেগে ওঠে বলা যায় না। ওটারই পাদদেশ আর খাড়াই শরীরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই নাকি দেখার মতো।সেন্ট্রাল প্যাসিফিক ওসেন অর্থাৎ মধ্য প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝে অবস্থিত আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম একটি স্টেট অর্থাৎ রাজ্য হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের অন্যতম একটি অংশ এই আগ্নেয়গিরি দ্বীপ।



হেডস্যারের তদ্বির-তদারকির ফল পাওয়া গেল কয়েক সপ্তাহের মধ্যে। ভারত সরকারের বিজ্ঞান মন্ত্রক থেকে পৌঁছে গেল পাঁচ ক্ষুদে-অভিযাত্রীর যাবতীয় ছাড়পত্র , টাকা-পয়সা ও উড়োজাহাজের আসা-যাওয়ার টিকিট।আমেরিকা সরকারের নিরাপত্তা বিভাগ থেকেও, অন-লাইনের মাধ্যমে ( কম্পিউটারের আন্তর্জাল ব্যবস্থার দ্বারা, যা ঘরে বসেই পাওয়া যায়), এসে যায় ভিসা(অনুমতি-পত্র)।

এরপর আর বসে থাকার প্রশ্নই নেই। এক সপ্তাহের মধ্যেই বুলটিরা রওনা দিয়ে দেয় আগ্নেয়গিরি দ্বীপের উদ্দেশ্যে।চব্বিশ ঘণ্টার মতো আকাশপথে মেঘের দেশের রাজকন্যাদের সঙ্গে গান গেয়ে হেসে-খেলে পনেরো হাজার কিলো-মিটার অতিক্রম করে পৌঁছে যায় হনলুলু,হায়োয়াই দ্বীপপুঞ্জের রাজধানী।তখন মোটে ভোর ভোর।

এবার সি-লঞ্চ(সাগর পারাপারের জন্য ছোটো আকারের জলযান) ধরতে হবে। নেমেই ওরা অনুভব করে শুধু শরীর নয়, হাড় কাঁপছে । লাউঞ্জে এসে যে যার লাগেজ খুলে গরম পোশাক বের করে পরে নেয় তড়িঘড়ি। মাথায় চাপিয়ে নেয় বাঁদর-টুপি। ওই গরম পোশাক পরেও বিট্টুস গলা কাঁপাতে কাঁপাতে বলে ওঠে ‘উ-হু-হু... কী ঠাণ্ডারে বাবা, এখানে তো শীতের সময় অর্থাৎ এই নভেম্বর-ডিসেম্বরে বরফ পড়ে রে , ভারী ভারী গরম পোশাক এনেছিস তো তোরা...।’ বলতে বলতে ওর বাঁদর টুপির ওপর একটা মাফলারও জড়িয়ে নিল সে। এই দৃশ্য দেখে বুলটিরা ঠোঁট চেপে হাসতে থাকে। ভোম্বল বলে ওঠে, ‘ আমরা যে গরম পোশাক পরেছি ওতেই তো হয়ে যাচ্ছে রে , আমাদের আর অতো ঠাণ্ডা লাগছে না’।

ডাব্বু বলে ওঠে, ‘শরীরে যদি একটু ঠাণ্ডা নাই লাগলো তাহলে মজা কোথায় রে...’!ভোম্বলের কথাটা শুনে বিট্টুস যেন একটু চুপসে গেল। তারপর বলল, ‘কী করব? জানিসই তো, ঠাণ্ডা লেগে গেলে আমার হাঁচি ওঠে। একবার শুরু হয়ে গেলে থামতেই চায় না’।

---তুই তো একটা ফার্স্টএইড-বক্স এনেছিলি, ওটা কোথায়?’ শিম্মি হাসতে হাসতে জানতে চায়।

---হ্যাঁ হ্যাঁ এনেছি, এনেছি, ওটা না এনে উপায় আছে নাকি রে, এই বিদেশ-বিভূঁইয়ে কার কখন পেট ছোটে, কার কখন নাক ছোটে...।’ বিট্টুসের এই কথাটি শুনে বুলটিরা সবাই হো হো করে হেসে ওঠে। বিট্টুসও যোগ দেয় ওই হাসিতে। তবে হো হো করে নয়, নিঃশব্দে দাঁত বের করে।

লাউঞ্জে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হল ওদের।মহম্মদ ইউনুস নামের যে লোকটির ওদের সঙ্গে দেখা করার কথা তার দেখা নেই। বুলটি মোবাইলে বার বার চেষ্টা করছে ওর সঙ্গে যোগাযোগ করতে। কিন্তু শোনা যাচ্ছে নট রিচেবল ...নট রিচেবল...।উত্তেজনায় সবার চোখমুখ রুখু রুখু...। অবশেষে একটু বাদে দূর থেকে একটি মোটাসোটা ধরনের লোককে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। লোকটির গাঁয়ের রং শ্যামলা, চেহারা অনেকটা ভারতীয়দের মতো।লোকটি ওদের দিকে হাত দেখাতে দেখাতে ‘গুড মর্নিং...গুড মর্নিং’ বলতে বলতে এগিয়ে এলো। বিনিময়ে বুলটিরাও তা করল। সে এসেই তার নিজের পরিচয় দেয়, ‘আমি ইউনুস,মহম্মদ ইউনুস, আপনেগ হেল্প করণের লাইগা আইছি। আপনেরা নিচ্চয় বেঙ্গলি চাইল্ড এডভেঞ্চারার গ্রুপ(বাঙালি খোকাখুকু অভিযানকারী দল)...আমার লাইগা ওয়েট(অপেক্ষা) করতাছেন?’

বুলটি বলে ওঠে, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ আমরা আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছি...’।

--- ঠিক আছে আপনেরা অখন এইখানে টি-ব্রেক(চা খাওয়া) কইরা লন, আমি আমার গাড়িটারে একটু সারভিসিং(ঠিকঠাক করানো) কইরা আনি...’।বলতে বলতে সে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয়। ওই মুহূর্তে বিট্টুস শুধোয়, ‘আপনি কি বাঙালি?’ ইউনুস হাসতে হাসতে জবাব দেয়, ‘হ,সোনারা আমি বাংলাদেশের ঢাকাইয়া বাঙালি,যে ট্র্যাভেলিং এজেন্সিতে(যে-কার্যালয় মানুষের ভ্রমণের ব্যবস্থা করে) কাম করি হেইটা একটা বাংলাদেশী এজেন্সি,ম্যানহাটনে(আমেরিকার একটি বিখ্যাত শহরে) অফিস,আমিই এজেন্সিটা চালাই..’।.বলতে বলতে খ্যাক খ্যাক হেসে দেয় ইউনুস,তারপর বেরোবার করিডোরের ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যায়।


চলবে ...