বুধবার, এপ্রিল ২৪, ২০২৪

একটি অভিশপ্ত দ্বীপভূমি, সেখানে থাকে এক জার্মান সাদা ভূত

নানা রকমের মানুষজন,তাদের পোশাকআশাক,কথাবার্তা,ঠাটবাটও নানা রকমের। এরা যাবে বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন দিশায়...। এদের দেখতে দেখতেই বুলটিদের সময় কেটে যাচ্ছে। এমন সময় ইউনুস এসে হাজির। বলে,’চল,সোনারা আমার গাড়ি রেডি...’। বুলটিরা ওকে অনুসরণ করে বিমান বন্দরের বাইরে আসে। বাইরে এসে ওরা দেখে একটা ক্রুসভ্যান গাড়ি দাঁড়িয়ে। ইউনুস ওদের সবাইকে গাড়িটিতে উঠতে বলে।ওরা সবাই উঠে হাত-পা ছড়িয়ে বসে। ইউনুস বসে চালকের আসনে।

সে আর সময় নষ্ট করে না,গাড়ি চালিয়ে দেয়...। ক্রমশ বাড়িয়ে দেয় গতি...ছুটতে ছুটতে লোকালয় ছাড়িয়ে ছুটে যায় নারকেলবনের ভেতর। তারপর আঁকাবাঁকা ছায়াশীতল নারকেলবীথি ধরে এগিয়ে যেতে থাকে।প্রায় ঘণ্টা-খানেক পর এসে থামে নির্জন একটি তটে।সামনে আছড়ে পড়ছে প্রশান্ত মহাসাগর। বুলটিরা অবাক হয়ে যায় জায়গাটিকে দেখে। এখানে কখনো কোনও মানুষজনের যাতায়াত হয় কিনা বোঝা যায় না! শান্ত ঘাটেরও কোনও চিহ্ন নেই।

ইউনুস ওদের নির্দেশ দেয়, ‘আহো সোনারা আমারে ফলো কর’ বলতে বলতে সে এগিয়ে যেতে থাকে সামনের দিকে। বুলটিরা অনুসরণ করে। একসময় ইউনুস নিয়ে যায় ওদের উঁচু একটা ঢিপির আড়ালে, ওখানে গিয়ে ওদের তো চক্ষু ছানাবড়া, বালুর উপর বসে রয়েছে একটি বড়সড় তিমিমাছ।বুলটিরা হা করে তাকিয়ে থাকে তিমিমাছটির দিকে আর ভাবতে থাকে, এখানে কোত্থেকে এল এই তিমিমাছটা!!তিমিমাছটিকে নিয়ে ওরা হতবাক হয়ে যাচ্ছে দেখে ইউনুস হাসতে থাকে।হাসতে হাসতে ওদের এই বিস্মিত হওয়া থেকে নিবৃত করে, ‘ আরে সোনারা ওইটা আসল তিমিমাছ না, ওইটা একটা সি-লঞ্চ। চোরা পথে হেই আগ্নেয়গিরি দ্বীপে যাইতে হইলে তিমিমাছ হইয়াই যাইতে হয়, হে লাগগাই আমাগ এজেন্সি তিমিমাছের আকারে বানাইছে এই সি-লঞ্চটারে। এইটারে এইখানেই লুকাইয়া রাখি আমরা । এইটা কইরাই তোমরা যাইবা হেই অভিশপ্ত দ্বীপে’।ইউনুসের কথাটা শুনে বুলটিরা রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে।

ওরা দেখে তিমিমাছ লঞ্চটির ওপরের ঝাঁপ খুলে গেল।ভেতরে বসে আছে একজন লোক।লোকটিকে দেখে বুলটির মনে হলো ওদের স্কুলের আর্ট স্যার,গোঁফ-ছাগলদাড়ি,চোখে চশমা । ইউনুস পরিচয় করিয়ে দেয় ওর, ‘হের নাম হেরম্ব গাঙ্গুলি, এই লঞ্চের পাইলট, আমাগ এজেন্সির নাম করা গাইডও (পথপ্রদর্শকও) , প্রশান্ত মহাসাগরের দেশগুলার ভূগোল-ইতিহাস হের নখদর্পণে (ওই বিষয়ে সব কিছু জানে) , এগুলা নিয়া বইও লিখে তোমাগ লাইগা, হেই তো তমাগরে লইয়া যাইব ওই দ্বীপে, জলদি উইটঠা পর তুমরা...।’ বলতে বলতে সে বুলটিদের ওই তিমিমাছ-লঞ্চে উঠতে সাহায্য করে একজন একজন করে।লঞ্চের পাইলট হেরম্ব গাঙ্গুলিও এগিয়ে আসে ওদের তুলে নিতে। পরিশেষে ইউনুস বেশ কয়েকটা পলিথিনমোড়া বিভিন্ন ধরনের খাবারের বাক্স তুলে দেয় লঞ্চে। সে জানায়, ‘এগুলা তুমাগ প্রতি আমাগ এজেন্সির ভেট অর্থাৎ উপহার।’ একসময় হেরম্ব পাইলট বলে ওঠে, ‘ছোট্ট বন্ধুরা এবার আমরা যাত্রা শুরু করব ...’। বলতে বলতে গিয়ার ধরে তিমিমাছ-লঞ্চের চালিকা-যন্ত্র চালু করে দেন তিনি। ইউনুস জানায় ওদের প্রতি বিদায় সম্ভাষণ। হেরম্ব গাঙ্গুলি তিমিমাছের ঝাঁপ ফেলে দেন।

যখন লঞ্চ ছাড়ে সূর্যটা তখন পুব দিক লাল করে প্রশান্ত মহাসাগরের উপর যেন ভাসছে।তট ছেড়ে লঞ্চটা যখন মাঝ সাগরের দিকে পাড়ি দেয় বিশাল বিশাল নীল ঢেউয়ের ভেতর রক্তরাঙা সূর্যটা যেন তখন হাবুডুবু খায়।বুলটিরা অবাক হয়ে দেখে ওই দৃশ্য।

বিট্টুস আপন মনেই বলে ওঠে, ‘নীল চারদিকে শুধু নীল, এই সাগরের জল এতো নীল হোলো কীভাবে?’ চালকের আসনে বসে থাকা হেরম্ব গাঙ্গুলি হাসতে হাসতে বলে ওঠেন, ‘জল তো নীল নয়, নীল এই সাগরের তলদেশ, তলদেশের ওই নীলই প্রতিফলিত হয় ওপরের এই জলে। প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশ ঘন নীল হয়।’

--ইয়েস ইয়েস ইউ আর রাইট স্যার...’। কে যেন হেরম্ব গাঙ্গুলিকে সমর্থন করে ওঠে।বুলটিরা চমকে উঠে চারদিকে তাকায় । কিন্তু তাদের দলের সদস্য ছাড়া আর কাউকে দেখা যায় না ! হেরম্ব গাঙ্গুলি হাসতে হাসতে বলে ওঠেন, ‘কেউ নয় কেউ নয়, এই তিমি মাছটাই কথাটা বলল, ও আমার নেওটা তো তাই সব কথায় আমায় সমর্থন করে যায়।’

---ও মা তাই নাকি তিমি মাছটা কথাও বলতে পারে’! শিম্মি আবাক হয়ে বলে ওঠে।

হেরম্ব গাঙ্গুলি গিয়ার ও স্টিয়ারিঙে (লঞ্চের গতি নিয়ন্ত্রণ করার যন্ত্র) হাত রেখেই জবাব দেন, ‘হ্যাঁ খোকা খুকুরা ও প্রয়োজনে টুকটাক কথাও বলে ফেলে...’।

ভোম্বল বলে ওঠে, ‘ও কি বাংলা বলতে পারে?’

হেরম্ব গাঙ্গুলিকে জবাব দিতে দেওয়ার আগেই তিমিমাছ বলে ওঠে, ‘ হ্যাঁ হ্যাঁ আমি বাংলা জানি,বলতেও পারি, বাট আই লাইক(পছন্দ করি)ইংলিশ হি...হি...হি...।’ বলতে বলতে ওটা জলের ওপর একটা লাফ মারল।বুলটিরা সবাই আতংকে চেঁচিয়ে উঠল। হেরম্ব গাঙ্গুলি হাসতে হাসতে বলে ওঠেন, ‘ ওকে আমরা কিন্তু বাংলাটা শেখাইনি, শুধু ইংরেজিটাই শিখিয়েছি,আমার সঙ্গে থাকতে থাকতে ও বাংলাটাও শিখে ফেলেছে ।’ বলতে বলতে তিনি সামনের কাচের ওপারে চোখ নিবিষ্ট করেন।

তিমিমাছ-লঞ্চ এগিয়ে চলে অভিশপ্ত আগ্নেয়গিরি দ্বীপের উদ্দেশ্যে। সবার চোখ সামনের দিকে...। মনের ভেতর চলছে পারদের ওঠা-নামা।এই বুঝি দেখা যাবে ওই দ্বীপ,এই বুঝি দেখা যাবে ওই দ্বীপ...।কারো মুখে কোনও কথা নেই...। সবার চোখেমুখে নিশ্চুপ উত্তেজনা...। সময় বোয়ে যায়...। একসময় হেরম্ব গাঙ্গুলি সে-নৈঃশব্দ্য ভাঙেন , ‘ছোট্ট বন্ধুরা ,তোমরা নিশ্চয় ভুচিত্রাবলি(মানচিত্র) দেখেছ, তোমরা যে দ্বীপটিতে যাচ্ছ, আগ্নেয়গিরি দ্বীপ, ওটা অবস্থিত এই প্রশান্ত মহাসাগরের একেবারে মধ্যিখানে । ওটার একদিকে রয়েছে মূল ভূমি আমেরিকার উত্তর-পশ্চিম দিক, আরেক দিকে রয়েছে জাপানের দক্ষিণ-পূর্ব দিক এবং আরেক দিকে রয়েছ অস্ট্রেলিয়ার উত্তরপূর্ব দিক। মূল আমেরিকা থেকে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ তথা আগ্নেয়গিরি দ্বীপের জলপথের দূরত্ব দু ঘণ্টার আর হনলুলু থেকে দূরত্ব এক ঘণ্টার।’

‘ইয়েস ইয়েস ইউ আর রাইট স্যার...’ তিমিমাছ সমর্থন করে।

ওই অবসরে ভোম্বল বলে ওঠে, ‘ স্যার আপনার কথা শুনে তো মনে হচ্ছে আপনি অনেক দেশ ঘুরেছেন, তাহলে ওই আগ্নেয়গিরি দ্বীপও নিশ্চয় ঘোরা হয়ে গিয়েছে আপনার?’

ভোম্বলের এই প্রশ্নটি শুনেও না শোনার ভান করে নিরুত্তর রইলেন হেরম্ব গাঙ্গুলি।হেরম্ব গাঙ্গুলির এই অবস্থা দেখে তিমিমাছটি হি হি করে হেসে উঠল।তারপর অনেকটা ভেংচাতে ভেংচাতে বলে,’কাওয়ারড(ভীতু)... কাওয়ারড(ভীতু)...।’ হেরম্ব গাঙ্গুলি ধমকে ওঠেন, ‘এই চোপ , বেশি বাড়াবাড়ি ভালো নয়...।’ তিমিমাছ আর কিছু বলে না।

হেরম্ব গাঙ্গুলি বুলটিদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘না ,আমার ছোট্ট বন্ধুরা, ওখানে যাওয়ার সাহস আজও অবধি আমি করে উঠতে পারিনি...তোমরা আমায় হারিয়ে দিলে বন্ধুরা...বিজয়ী হয়ে ফেরো তোমরা, আমার আশীর্বাদ রইল...।

###

...এ ভাবেই হেরম্ব গাঙ্গুলি,তিমিমাছ ও বুলটিদের মধ্যে আলাপচারিতা,মজা করা, লঞ্চের যান্ত্রিক গুনগুনানি আর সাগর-তরঙ্গের গম-গম গর্জনের ভেতর সময় এগিয়ে যায়।ঠাণ্ডার তীব্রতাও বাড়তে থাকে,যেন বাতাসে মিশে আছে বরফের অসংখ্য রেণু।হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছে। মাঝে মধ্যে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যায় বড় বড় সাদা রঙের পাখি ।বুলটিরা অবাক হয়ে দেখে পাখিগুলো সাগরের খরস্রোতের ওপরে নির্বিবাদে সাঁতারও কাটছে।বুলটি হেরম্ব গাঙ্গুলির কাছে জানতে চায়, ‘স্যার এগুলি কী পাখি?’ হেরম্ব গাঙ্গুলি জবাব দিলেন, ‘এই পাখিগুলিকে বলে অ্যালবেট্রস,এক ধরনের সামুদ্রিক পাখি,যেগুলির বাসস্থান এই প্রশান্ত মহাসাগর আর দক্ষিণ ভূখণ্ডের অন্যান্য সাগরগুলিতেই হয়ে থাকে...’।

তিমিমাছ লঞ্চ এবারেও হেরম্ব গাঙ্গুলিকে সমর্থন করে, ‘ইয়েস ইয়েস, ইউ আর করেকট স্যার, ইউ আর করেকট...’।

বুলটিরা লক্ষ্য করে, তিমিমাছ-লঞ্চটি যতই গভীর সাগরের দিকে তোড়ে জল কাটছে ঢেউয়ের মারকুটেপনা বেড়ে যাচ্ছে। কখনো কখনো ঢেউগুলি এতোই উপরে উঠে যাচ্ছে যে মনে হচ্ছে যেন ওদের চারপাশে নিমেষে উঠে যাচ্ছে উঁচু উঁচু জলের প্রাচীর। বুলটি ,শিম্মি, ভোম্বল, বিট্টুস আর ডাব্বু-- সবার চোখে মুখে শঙ্কা, লঞ্চটা যখন উঁচু উঁচু ঢেউয়ের মাথায় উঠে পড়ে তখন ওরা... ও মাগো...ও মাগো...বলে চেঁচিয়ে উঠছে। আবার যখন নীচে নেমে আসছে একসঙ্গে হেসে উঠছে। হেরম্ব গাঙ্গুলি ক্ষুদে-অভিযাত্রীদের এই উচ্ছ্বলতা দেখে আপ্লুত হয়ে উঠছেন আর হাসছেন...। সঙ্গে হাসছে তিমিমাছটাও।

এক সময় দূরে দেখা যায় ছোট্ট একটি মাটির বিন্দু জলের উপর মাথা তুলেছে। লঞ্চ যতই এগোচ্ছে ওই মাটির বিন্দু আস্তে আস্তে বড় হয়ে উঠছে।বড় হতে হতে ওটা এক সময় একটা পাহাড়ের চুড়োর মতো হয়ে উঠতে লাগলো। চুড়োটাও বড় হতে থাকে...। চুড়োটা যখন ক্রমে ক্রমে একটা খাড়া পাহাড় হয়ে ওঠে তখনই হেরম্ব গাঙ্গুলি চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘এই তো এই তো এই সেই আগ্নেয়গিরি, যেখানে তোমরা যাচ্ছ...’।

তিমিমাছও বলে ওঠে, ‘ ইয়েস,ইয়েস ইট ইজ ইওর ডিজায়ারড ভোলকানো আয়ল্যান্ড।‘( হ্যাঁ হ্যাঁ এই সেই আগ্নেয়গিরি দ্বীপ, যেটাকে তোমরা চাইছ।)

চলবে ...