বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৮, ২০২৪

উত্তরকথা, প্রান্ত কথা... পর্ব ৪

ফুলতী গীদালীঃউত্তরের লোকজীবনের আয়না


মাইল মাইল হলুদবরণ সরিসার খেত চারদিকে। এক বেটেখটো বৃদ্ধা ঘুরে ঘুরে নাচছেন,ঢাক ও ঢাকির শরীরের দুলুনির সঙ্গে আর মৃদু সুরে গাইছেন ---

‘দুঃখ কপালের লেখা,মৃত্যু লেখা পায়রে

আহারে দারুণ বিধি খন্ডন না যায়’

বৃদ্ধার চোখে আনন্দের অশ্রু।জরা তাকে নাচ আর গানের জীবন থেকে সরিয়ে রাখতে পারে নি।বৃদ্ধা হাঁফাচ্ছেন।অথচ তার চোখে ছানি,কিন্তু ছানি কাটাবার পয়সা নেই।বৃদ্ধা যে শাক কুড়িয়ে,ঘুটে বিক্রি করে সংসার চালান।আর গাননাচের দুনিয়ায় গনগণে এক জীবনেই ডুবে থাকেন।মজে থাকেন।

আজ থেকে প্রায় ২২ বছর আগে দেখা দৃশ্যটিকেই ফিরিয়ে আনলাম এই লেখার শুরুতেই।সেই বৃদ্ধা এখন খ্যাতি,পরিচিতি অর্জন করেছেন।সেভাবে আর্থিক দৈন্যতাও আগের মতন নেই।আজ প্রায় ঘরবন্দী তিনি।শ্বাসকষ্টে ভোগেন।জরার থাবা শরীরময়।কিন্তু গান ছাড়েনি তাকে।তিনি আর কেউ নন।তিনি ফুলতি আবো।ফুলতি গীদালি।জনমানুষের কাছে তিনি ‘সাইটোল রাণী’।

পশ্চিমবাংলার উত্তরখন্ডের ৭ টি জেলা নিয়ে বর্তমান উত্তরবাংলা নামক ভূখন্ডটি পরিচিত।নানা ভাষা,অসংখ্য ছোট ছোট এথনিক জনগোষ্ঠী,ভূমিপুত্র রাজবংশী,আদিবাসী জনসমাজ,পার্বত্য অঞ্চলের খন্ড খন্ড বাচিক জনমানুষের বর্ণময় বৈচিত্রের পাশাপাশী অগনণ নদী-শাখানদী-নদী টুকরো- ঝোরা-ঝোপঝাড়-হাওড়-বিল- কুড়া-দহ; মাইল মাইল ফাঁকা মাঠ(নিধুয়া পাথার),বৈচিত্রপূর্ণ অরণ্যভূমি,গুল্মলতা,জীবজন্তু,বৃষ্টিপাত আশ্চর্য কালবৈশাখী হাওয়া_ সব কিছু মিলেমিশে একাকার হয়ে লীন হয়ে যেতে থাকে আদিঅন্তহীন আবহমান এক উত্তরবাংলার সামগ্রিকতায়।

উত্তরবাংলার লোকায়ত জীবন,সামাজিক স্তরবিন্যাস,কৌম সমাজ এবং এর মহার্ঘ্য,মূল্যবান লোকসংস্কৃতি এক অতুলনীয় সম্পদ হিসেবেই অনায়াসে বিবেচ্য হতে পারে। লোকজীবনের আলো-অন্ধকার আদিম এথনিকতা,লাটিন আমেরিকার জাদু বাস্তবতাকে মনে করায়;যদিও বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি, নগরায়ন,শিল্পায়ন, পাশ্চাত্য সংস্কৃতির উগ্র আগ্রাসন উত্তরবঙ্গের লোকসমাজ ও তার সংস্কৃতিকে প্রতিমুহূর্তে শক্ত চ্যালেঞ্জ ও অস্তিত্বের সংকটের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে।ফলশ্রুতিতে প্রতিদিন হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের ভাষা,লোকশিল্প ও লোকসংস্কৃতির অসংখ্য উপাদান।

উত্তরবাংলার বহু লোকাচার ও সংস্কৃতি বিলুপ্ত এবং বিলুপ্তপ্রায় এখন।তবুও গ্রামেগঞ্জে প্রচারের আলোর বাইরে থেকে;অর্থ এবং যাবতীয় সংকটের তোয়াক্কা না করেও এমন অনেক শিল্পী আছেন যারা ভালোবাসার তীব্র টানেই বহন করে চলেছেন লোকসংস্কৃতি্র লোকায়তের বহুবর্ণ পতাকা।এমনই একজন প্রান্তবাসী__ফুলতী বর্মণ। জনমনে যিনি পরিচিত ‘সাইটোল সম্রাজ্ঞী’,ফুলতী গীদালী নামে।

‘সাইটোল’ উত্তরবাংলার রাজবংশী জনগোষ্ঠীর অন্যতম একটি লোকাচার। নুতন জন্ম নেওয়া শিশুর সুখী ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যত কামনায় রাজবংশী মহিলারা দল বেঁধে,দলবদ্ধভাবে নৃত্যগীতের মধ্য দিয়ে ‘সাইটোল’ পরিবেশন করেন।সাথে থাকে পুরুষ দোয়ারী বা দোহারবৃন্দ এবং ঢোল,কাঁশি,ঢাক,সারিন্দা ইত্যাদী বাদ্যযন্ত্র।এছাড়া নানান মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানেও ‘সাইটোল’ পরিবেশীত হয়ে থাকে।বর্তমানে ৯৪ বছর বয়ষ্কা ফুলতী গীদালী থাকেন কোচবিহার জেলার দিনহাটা মহকুমার পুঁটিমারী গ্রামে।বিগত ৬০/৬৫ বৎসর তিনি ‘সাইটোল’ পরিবেশন করে আসছেন।প্রায় সমগ্র উত্তরবংগ এবং অসমের গোয়ালপাড়ার(বৃহত্তর) মানুষের কাছে তিনি ‘সাইটোল সম্রাজ্ঞী’ বলেই পরিচিত।

বর্তমানে ফুলতীর চোখে ছানি।সমগ্র শরীরময় জরার থাবা।তবুও ডাক এলেই চেষ্টা করেন অমূল্য দেবনাথের দলের সঙ্গে বা কখনো একক দল নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ছুটে যাবার।আর সুরের তালে তালে নেচে নেচে উদাত্ত গাইতে থাকেন,

‘বানিয়া বন্ধুরে রসিয়া বন্ধুরে/হামার বাড়ি/সাইটোল পূজা

ঢাকের বায়না দে’...

প্রায় ৯৫ ছুঁই ছূঁই বয়সে ফুলতী গীদালী এখনো লাঠিতে ভর দিয়ে মাইল মাইল হলুদবরণ সর্ষেখেতের ব্যপ্ততায় নদীর বহমানতার প্রাবল্যে মাঠ-প্রান্তরের ভিতর শিল্পীসত্বার জারকরসে অন্তহীন ডুবে গিয়ে নাচুনি মেয়েদের সাথে ঢাকের তালে তালে ছড়িয়ে দেন সাইটোল গানের কলিসকল,

১। ‘দে দে দে/কালা মোকে

বাঁশিকোনা/দে’...

২। ‘প্রানের বন্ধু রে/সোনার বন্ধু রে

দে ক্যানে দে/মোকে/একনা

নোলোক গড়েয়া দে’...

৩। ‘দিনগুলান সউগ বদলি গেইচে/রে

য্যালা আসিল ওরে/বড় বানা

স্যালা থাকি দেখং/দ্যাশত

বড়ো বদল/চইলছে/রে’...

৪। ‘রাজার ছাতা ভাঙিয়া পড়ে/মুঞ্জিয়া যায়

নদীর কাছাড়/এলুয়া কাশিয়ার ঝাড় রে’...

৫। ‘তবু কি আর মন মানে রে/পুরান মানষির

পুরান গান/মনটায় কয়/রাজা আছিল/ভালা আছিল

ঐটায় হইল/সাচা কাথা’...

৬। ‘সিদোল প্যালকা খায়া নাচি/গাং ভাওয়াইয়া গান

দুপর নাই/ট্যাপর নাই/নাই ফাকোতে

ফুলতী আবো/গুনগুনিয়া রয়’...

৭। ‘সাইটোল নাচিবার তানে দেখং/কুনবেলা বা

ভাঙিয়া গেইছে/মোর সাধের/সারিন্দাকোনা রে’...


পশ্চিমবাংলা সরকার এই অনবদ্য লোকশিল্পীকে সম্মানিত করেছেন।সরকারী ভাতার ব্যাবস্থা করে দিয়েছেন।এ ছাড়া বিভিন্নবেসরকারী ও স্বেছাসেবী সংস্থা/সংগঠন ফুলতী গীদালীকে সংবর্ধনা-সম্মান প্রদান করেছেন।উত্তরের লোকায়ত জনজীবন জনসংস্কৃতি সব যেন সর্বাঙ্গে জড়িয়ে ধরে ‘সাইটোল সম্রাজ্ঞী’ ফুলতী গীদালীকে।ফুলতী বর্মণ, মানে ফুলতী গীদালী তাই বর্ণাঢ্য লোকজীবনের প্রকৃত দর্পণ,সন্দেহাতীতভাবেই।ফুলতী গীদালি কেবলমাত্র একজন লোকশিল্পীর নামই নয়,ফুলতি গীদালিআজ উত্তরের এক ‘মিথ’।জীবন্ত কিংবদন্তি।উত্তরাঞ্চলের অহংকার।আমাদের অনন্য অর্জন।


চলবে ...