বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৮, ২০২৪

আমরা শাড়ি পরব না, পরব না শাড়ি, পর্ব --৯

দেবলীনা সেনগুপ্ত --

জন্ম রেলশহর মালিগাঁও, গুয়াহাটি, অসম. পড়াশোনা পরিসংখ্যা বিষয়ে। স্নাতক স্তরে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম। স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয়। অসম সরকারের অর্থবিভাগে বরিষ্ঠ গবেষণা আধিকারিক হিসেবে কর্মরত।

আবৃত্তি ও বাচিকশিল্পে আগ্রহী। দুটি প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও রয়েছে বহু অগ্রন্থিত কবিতা, কিছু ছোট গল্প, নিবন্ধ ইত্যাদি।
কবিতা, বই ও অভিনয়.. আজন্মের নেশা ও ভালোবাসা।


শাড়ি। স্বপ্ন। আকাঙ্খা। একটি শাড়ি একটি স্বপ্ন, এক নিভৃতের আকাঙ্খা। এক বহমানতা। নারী হৃদয়ের যা কিছু গোপন গহন রহস্য, নারীতনুর যা কিছুর বঙ্কিম বিভঙ্গ--- তার সর্বোত্তম মধুর প্রকাশ বোধহয় শাড়িতেই ঘটে।অন্ততঃ আমার তাই মনে হয়। উৎসবে ,পার্বণে, অনুষ্ঠানে , সভাঙ্গনে , শোকে, সুখে, প্রেমে, বিষাদে...সর্বত্রই এক অন্য মাত্রা যোগ করে এই শাড়ি।

5f95b776b6e6a.jpg

মায়ের শাড়ির আলমারি কিশোরী মেয়েটির চোখে ছিল এক স্বপ্নজগত। আলমারি খুললেই থরে থরে সাজিয়ে রাখা শাড়ির সুবাস তার নাকের মধ্য দিয়ে একেবারে মরমে পৌঁছে যেত।একেকটি শাড়ির একেক নাম দিত সেই কিশোরী মেয়ে।ধূপছায়া রঙের যে শাড়িতে ছিল সোনালী ধানছড়ার আলপনা, তার নাম সে দিয়েছিল ‘হেমন্ত’। ফিরোজা রঙ একঢালা শাড়িকে বলতো ‘শরৎ’। আর, লাল রঙের যে রেশমী শাড়িটির আদ্যোপান্ত জুড়ে ছিল বিচিত্র শান্তিনিকেতনী কারুকাজ, তাকে সে ডাকতো ‘উৎসব’ বলে। পুরোটাই অবশ্য মনে মনে। শাড়ি তার মনোজগতের দখল নিয়েছিল অনায়াসে।

5f95b7ae10d10.jpg

তারপর একদিন যখন স্কুল কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে মেয়ে পৌঁছাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনায়, মায়ের শাড়ির আলমারির দখল নিল সে। প্রতিদিন একটা করে স্বপ্ন গায়ে জড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আঁক কষতে যেত সে। ক্রমে শাড়িই হয়ে উঠলো তার প্রিয়তম অঙ্গরাগ। তার সমবয়সী বন্ধুনীরা যখন নানা আধুনিক দেশজ ও পাশ্চাত্যপ্রিয় বেশভূষায় শোভিত হয়ে এসে নিত্যদিন সকলকে তাক লাগিয়ে দিত, সে শাড়ির ময়ূরপঙ্ঘী আঁচলটি আলতো টেনে নিত কোমল বরতনুতে। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে চেনাতে গিয়ে অনেকেই বলে উঠতো …’ঐ যে শাড়ি পরা মেয়েটি…’

5f95b7db99a95.jpg

দিনে কালে আরো বড় হল সেই মেয়ে।পড়াশোনার পাট চুকিয়ে(সে কি আর চোকে! সারা জীবনটাই তো পাঠের পাট) বেশ একখানা ভারিক্কি গোছের চাকরিও জুটিয়ে ফেললো।ব্যস.. তাকে আর পায় কে? শাড়ি কেনার, পরার আর দেখানোর রাস্তা একেবারে সুমসৃণ হয়ে গেল...

প্রথম মাইনে পেয়েই মেয়ে মাকে কিনে দিয়েছিল মুগা রং তসর... সারা শাড়িতে সিঁদুর লাল রেশমী সুতোর মনোরম কারুকাজ। শাড়িটির নাম সে দিয়েছিল "অঞ্জলি’।

এখন এই মধ্যবয়সে এসে সে বেশ বুঝতে পারে.. তার এই এতটুকু জীবনে চরম দুর্বলতা বলতে যদি কিছু থেকে থাকে, তা হল বই এবং শাড়ি। দুটোই এক নম্বরে।

5f95b806c753a.jpg

শাড়ির ব্যাপারে এই মধ্যবয়সিনী কিন্তু বেশ খুঁতখুঁতে।যা হোক একটা কিছু হলেই কিন্তু চলবে না... বা গাদা গুচ্ছের দামী হলেই যে মনপসন্দ হবে তাও নয়। শাড়িটিকে আগে "তার’ মতো হয়ে উঠতে হবে। মানে শাড়িটি যেন শুধুমাত্র পরিধেয় হয়ে না থেকে হয়ে ওঠে তার স্ব –ভাব। তার যা কিছু কথা বলা হল না, তা যেন থাকে ঐ শাড়ির ভাঁজে, যে গানের সুর তার গলায় ফুটল না, তা যেন ফুটে ওঠে শাড়ির কারুকাজে. যে সবুজ বর্ষাজলে স্নান করতে চেয়েও সে পারেনি, কচি কলাপাতা রং আঁচলে যেন ছড়িয়ে থাকে সেই বৃষ্টি দিনের আলো....আর, আর যখন সে পরবে রাত্রিনীল বা কাজলকালো বসনটি, রাতের সব তারার ফুল যেন প্রিয় কবির কবিতা হয়ে ভরে দেয় তার নারীজীবন, তার অহঙ্কারের অলঙ্কার হয়ে বেজে ওঠে নিভৃতের মধুযামিনীতে।

5f95b8290a22a.jpg

এবার পুজো কতখানি কি হবে, তা নিয়ে দোলাচল একটা রয়েছে বৈকি! তবে শাড়ি কিনতে বাধা কোথায়... শাড়িই বোধহয় এমন একটি পরিধেয়, যেখানে সাধ ও সাধ্যের মেলবন্ধন কঠিন নয়। আর বিপণি তো হাতের মুঠোয়। অর্থকরী লেনদেনও চোখের নিমেষেই হয়ে যাচ্ছে। অফিস ডেস্কে বসেই ছোট্ট অবসরে শাড়ি বাছাই হয়ে যায়। টুক করে অর্ডারটুকু দিয়ে ফেললেই কাজ সারা। সেভাবেই কেনা হয়ে যায় কয়েকটি। এছাড়া উপহার, প্রাপ্তি এসব তো রয়েইছে।

5f95b85605a16.jpg

ষষ্ঠী

ষষ্ঠীর সন্ধের জন্য পছন্দ বিশুদ্ধ সুতির ওপর লক্ষ্নৌ চিকনের কাজ‌।দুধে আলতা রংয়ের শাড়ির ওপর ঘন নীল সুতোর চিকনকারি কাজ, সংগে মানানসই জামা ও হাল্কা গয়না। ব্যস.. ডিজিটাল বোধনের জন্য সাজ তৈরি।


সপ্তমী

সকাল বিকাল দুবেলাই পছন্দ বাংলার হাতে বোনা তাঁতের কোমলতা। সকালে ঘননীল জমির ওপর সোনালী মীনাকারি নকশা আর রাতে পুরো কালো জমির ওপর মুগার জ্যামিতিক প্যাটার্ন।বাড়ি বসে পুজো দেখার জন্যে যথেষ্ট।

অষ্টমী

সকালে অবধারিত জামদানি। অঞ্জলি উপযোগী দুধ সাদা জমিতে রানি রঙের ভরপুর নক্সাদারি।

বিকেলের জন্য আবার সেই কালো। কালো রেশমের ওপর আগাগোড়া শান্তিনিকেতনী রংবাহারী কাঁথাকাজ... আহা চোখের আরাম,প্রাণের শান্তি।

নবমী

সকালে হাল্কা বেগুনীর ছোঁয়া লাগা জমিতে জমকালো চওড়া পারের চেট্টিনাড় সুতি। সংগে কলমকারি ব্লাউজ।

রাতে কালো লিনেন সিল্ক... সোনালী বুটির স্বপ্ন ছড়ানো,মাখানো।

দশমী

অফ হোয়াইট জরি জামদানি আর সিঁদুর লাল জরিকাজ ব্লাউজের যুগলবন্দী. মায়ের বরণ ও বিসর্জন।

পুজোর সময় তো বটেই, সারা বছর জুড়েই শাড়িই প্রথম ও চরম পছন্দের। তবে সেই সব শাড়ি,যার সংগে জুড়ে আছে দেশের কোন না কোন অংশের ঐতিহ্য। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের শাড়িশিল্প, ঐতিহ্য এবং ইতিহাস সত্যি অসাধারণ। আর অসমদুহিতা হিসেবে আসামসিল্ক তো একটু বেশিই ভালোবাসার। মরমী অসমী আইয়ের স্নেহপরশ যেন শাড়ি জুড়ে।

এটুকু বলতেই পারি হলফ করে, সব বেশ, সব সাজ আসবে যাবে ঘুরে ফিরে । কিন্তু নারী অঙ্গে শাড়ির শোভার আবেদন চিরন্তন, আধুনিক ও অপরিহার্য।